মঙ্গলবার আন্দোকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি। —নিজস্ব চিত্র।
জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে আশঙ্কার মেঘ এ বার উত্তরবঙ্গে। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে গজলডোবা এলাকায় জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে আন্দোলনের পথে কৃষকরা। অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের রাশ ইতিমধ্যেই হাতে নিতে সক্রিয় বিজেপি-র সংগঠন ‘কৃষক মোর্চা’।
গত অক্টোবরে গজলডোবায় তিস্তা নদীর সেচ বাঁধের পাশে পর্যটক হাব গড়ে তোলার ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রায় ২১০ একর জমির উপর গড়ে ওঠার কথা ছিল ‘ভোরের আলো’ নামে ওই পর্যটক হাবের।
সেই ‘ভোরের আলো’ প্রকল্পকে কেন্দ্র করেই গজলডোবা থেকে বেলাকোবা হয়ে বোদাগঞ্জের মিলনপল্লি এলাকায় মঙ্গলবার প্রবল বাধার মুখে পড়লেন সরকারি কর্মী এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা ঠিকাদার সংস্থার কর্মীরা। আন্দোলনকারী কৃষকদের দাবি, প্রস্তাবিত পর্যটক হাব থেকে বেশ কিছুটা দূরে মিলনপল্লি এলাকায় কয়েক দিন আগে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ভূমি রাজস্ব দফতরের কিছু কর্মী জমি মাপজোক করা শুরু করেন। কী উদ্দেশ্যে জমি মাপজোক, তা নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা প্রশ্ন করলে তাঁদেরকে জানানো হয়, ‘ভোরের আলো’ পর্যটন হাবের জন্য ওই জমি অধিগ্রহণ করবে রাজ্য সরকার। ওই সময় তাঁরা প্রকল্পের একটি বোর্ডও লাগিয়ে দিয়ে যান।
আরও পড়ুন: ভাটপাড়া পুরসভা দখল করল বিজেপি, পুরপ্রধান হলেন অর্জুনের ভাইপো সৌরভ
প্রস্তাবিত প্রকল্পের এই বোর্ড উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা। —নিজস্ব চিত্র।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, তাঁরা ঘুণাক্ষরেও কখনও জানতে পারেননি ওই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। তিস্তা নদীর চর সংলগ্ন ওই জমি তিন ফসলি। ওই এলাকার মানুষ মূলত কৃষিজীবী। আন্দোলনকারীদের দাবি, বাম সরকারের আমলে ২০০০ সালে তাঁদেরকে ওই জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছিল। ভূমি রাজস্ব দফতরের কাছে সেই সমস্ত নথিও রয়েছে। তা সত্ত্বেও পাট্টা পাওয়া কৃষকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে বা তাঁদেরকে না জানিয়ে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে সরকার।
আন্দোলনকারীদের দাবি, কী প্রকল্পের জন্য এবং কতটা জমি অধিগ্রহণ করা হবে তা নিয়েও কোনও স্পষ্ট বার্তা দেননি সরকারি আধিকারিকরা। এক কৃষক বলেন, ‘‘সরকার প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু অধিগ্রহণের নিয়ম আছে। জমির মালিক বা জমির স্বত্বভোগীকে নোটিস পাঠাতে হয়। শুনানি করতে হয়।” অভিযোগ, কোনও পদ্ধতি না মেনেই মঙ্গলবার হঠাৎ সরকারি কর্মী এবং ঠিকাদার সংস্থার কর্মীরা প্রকল্পের আরও কয়েকটি ফলক লাগাতে আসেন।
আরও পড়ুন: মেয়াদ শেষ করতে পারবে না তৃণমূল সরকার, বিদ্রোহের পথে একঝাঁক বিধায়ক, দাবি বিজয়বর্গীয়র
বিক্ষোভকারী কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকে বিজেপি-র কৃষক মোর্চার নেতা অরুণ মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।
গত কয়েক দিন ধরেই অধিগ্রহণের ‘বার্তা’কে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হচ্ছিল গোটা এলাকা। এ দিন সকালে সরকারি কর্মীরা পৌঁছলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়। এলাকার কৃষকরা সরকারি কর্মীদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ওই কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ থাকলেও বিক্ষোভকারীদের তুলনায় তার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। বিক্ষোভকারীরা প্রকল্পের বোর্ড উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। শ’দুয়েক কৃষক সামিল হন বিক্ষোভে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আশপাশের থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী চলে আসে। শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেন পুলিশ কর্তারা। ঠিক হয়, তিন দিনের মধ্যে ভূমি রাজস্ব দফতরের কর্মীরা আলোচনায় বসবেন। উত্তেজনা সাময়িক ভাবে কমলেও আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তাঁরা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানবেন না। আন্দোলনকারী এক কৃষক বলেন,‘‘ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই এখানে কৃষকদের অন্ধকারে রেখে জমি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা কিছুতেই মানব না।”
অন্য দিকে, ২১০ একর জমি ‘ভোরের আলো’ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ হওয়ার কথা থাকলেও, এর পর প্রস্তাবিত পর্যটক হাব থেকে দূরে ফের কিসের জন্য অধিগ্রহণ, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি সরকারী কর্মীদের কাছ থেকে। তবে তাঁদের একাংশের দাবি, পর্যটক হাবের জন্য প্রয়োজনীয় হেলিপ্যাড এবং রাস্তা তৈরির জন্য ওই জমি প্রয়োজন।
পাট্টার নথি নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলনকারীদের। —নিজস্ব চিত্র।
কৃষকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিজেপি। এ দিনের বিক্ষোভে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির কৃষক শাখার রাজ্য সম্পাদক অরুণ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কোনও ভাবেই কৃষকদের জমির অধিকার কেড়ে নিতে দেব না। এ জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।” তবে তৃণমূলের পক্ষ থেকে কারওর কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, যে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তা মূলত সরকারি খাস জমি। সাড়ে আট একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেই জমিই চিহ্নিত করে ফলক লাগাতে গিয়েছিলেন কর্মীরা।
কিন্তু তা মানতে রাজি নন বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের একটি অংশের দাবি, বিভিন্ন সূত্র থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, আরও অনেক বেশি জমি ধাপে ধাপে অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা করছে সরকার।