মঞ্চে: শ্রীনিকেতনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
বীরভূমে রাজনৈতিক হিংসার প্রসঙ্গে এত দিন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই অভিযোগ তুলত। এ বার সেই অভিযোগ উঠে এল খোদ রাজ্যপালের মুখে! বুধবার শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসবে এসে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় দাবি করলেন, বীরভূম এখন বোমা তৈরির কারখানা। শুধু তাই নয়, গরু পাচারেও এই জেলার ভূমিকা রয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
রাজ্যপালের এই অভিযোগ ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এর আগেও তিনি নানা বিষয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়েছেন। এ বার বীরভূমে এসে পরোক্ষে শাসকদল এবং পুলিশ-প্রশাসনকেই নিজের আক্রমণের নিশানা করলেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। হলকর্ষণ উৎসবের সূচনা করার পরে বিশ্বভারতীর বাংলাদেশ ভবনে এক সাংবাদিক বৈঠকে ধনখড় বলেন, ‘‘বীরভূম বলতেই এখন কানে আসে বোমার কারখানা, মাফিয়া রাজ। এটা বীরভূমের পরিচয় হতে পারে না। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে আক্রমণ করার সামগ্রী তৈরি হচ্ছে শান্তিনিকেতনের ২০-৩০ কিলোমিটারের মধ্যেই! গরুপাচারে বীরভূমের ভূমিকাও সকলেই জানেন। সাংস্কৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ বীরভূমের আজ এ কোন দশা!’’
রাজ্যপালের মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছে জেলা তৃণমূল। দলের সহ-সভাপতি অভিজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘এক জন রাজ্যপালের কাছে আমরা একটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের মতো ভাষণ বা বিবৃতি এর আগে শুনিনি। উনি যে কথাগুলো বলেছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। রাজভবনে রাজার মাথা থেকে গ্রামের মানুষের কথা এ ভাবে ভাবা যায় না বা বলা যায় না।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘রাজ্যপাল কি শুধু এ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা দেখতে পান, উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাতের কথা ওঁর নজরে পড়ে না?’’
এ দিন ভোর ৫টায় শ্রীনিকেতন পাকুরতলা থেকে ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো’ গানে বৈতালিক শুরু হয়। শেষ হয় কুঠিবাড়ির সামনে। অন্য বছর এই উৎসব ২৩ শ্রাবণ পালিত হলেও করোনা পরিস্থিতিতে এ বার দিন পরিবর্তন হয় উৎসবের। এ দিন সকাল আটটা চল্লিশ নাগাদ শান্তিনিকেতনের পিএসবি হেলিপ্যাডে নামেন রাজ্যপাল। সেখান থেকে পৌঁছন শ্রীনিকেতন মেলার মাঠে। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, কর্মসচিব আশা মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করেন সস্ত্রীক রাজ্যপালকে। শ্রীনিকেতন মেলার মাঠে রাজ্যপালের উপস্থিতিতে উদ্বোধন হয় হলকর্ষণ উৎসবের।
হলকর্ষণ উৎসবের মূল ভাবনা ফুটিয়ে তুলে শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রীরা ‘ফিরে চল মাটির টানে’ গানটি পরিবেশন করে। এর পরে বেদমন্ত্র পাঠ ও তারপর আরও দুটি গান পরিবেশন হয়। সব শেষে প্রতীকী হলকর্ষণ ও বীজ রোপণ করেন রাজ্যপাল, উপাচার্য সহ উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা স্বল্প হওয়ায় এবং পড়ুয়াদের অনুপস্থিতিতে হলকর্ষণের বিশেষ শোভাযাত্রা ও নৃত্যানুষ্ঠান এই বছর বাতিল করা হয়। কৃষকদেরও এই বছর আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি পালিত হয়েছে। মঞ্চে যাঁরা যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের করোনা টেস্ট করানো হয় দু’দিনের মধ্যেই। রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেই প্রবেশের ছাড়পত্র পান। প্রবল বৃষ্টিতেও অনুষ্ঠান বেশ খানিকটা বিঘ্নিত হয়।
রাজ্যপাল রবীন্দ্রভবনে একটি স্থায়ী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। রবীন্দ্র সমকালীন শান্তিনিকেতনের কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনী তৈরি হয়েছে। তবে, হলকর্ষণের জন্য বিশেষভাবে সজ্জিত একটি বলদ হঠাৎ হালের দড়ি খুলে ইতস্তত দৌড়তে শুরু করে। উপস্থিত কর্মী, আধিকারিক ও নিরাপত্তা কর্মীরা স্বভাবতই বিড়ম্বনায় পড়ে যান। সকলেই সেটিকে ধরতে ছোটেন। প্রায় পাঁচ মিনিট ছোটাছুটির পরে আবার সেটিকে হালে জোড়া হয়।
রাজ্যপাল শান্তিনিকেতনে আসার আগের রাতে শ্রীনিকেতন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেল দেওয়াল লিখন। সব কটি দেওয়াল লিখনেরই মূল বিষয় রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় ও উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বিরোধিতা। ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিও জানানো হয়। কর্তৃপক্ষের নজরে আসতেই দেওয়াল লিখন মুছে ফেলা হয়েছে।