মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিমল গুরুং।
রাজ্যের রাজনীতিতে বিমল গুরুংয়ের প্রত্যাবর্তন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর হাত মেলানো পাহাড় এবং পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় বিধানসভা ভোটে কী প্রভাব ফেলতে পারে? রাজ্য রাজনীতিতে গত ২৪ ঘন্টা ধরে এটাই অন্যতম আলোচ্য।
গুরুংয়ের প্রত্যাবর্তনের নেপথ্যে তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) ভূমিকা রয়েছে বলেই রাজ্যের শাসক দল সূত্রের খবর। তবে বিরোধী শিবিরের মতে, এই ঘটনায় পাহাড়ের রাজনীতি কোনও নতুন সমীকরণ ডেকে আনবে না।
তৃণমূলের দাবি এবং আশা, পাহাড়ের ৩ বিধানসভা আসন-সহ তরাই ও ডুয়ার্স মিলিয়ে মোট অন্তত ১৫টি আসনে তাদের সুবিধা করে দেবে গুরুংয়ের সমর্থন। বুধবার রাতেই টুইট করে গুরুংয়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন মমতা। তৃণমূলের তরফে প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া আপাতত ওইটুকই। তবে ঘনিষ্ঠ বৃত্তে তৃণমূল নেতারা দাবি করছেন, পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স মিলিয়ে ওই ১৫টি আসনে গুরুং ‘প্রভাবশালী’। ফলে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ওই আসনগুলোয় তৃণমূলের সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল হল। যেখানে লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে ওই সব আসনে লড়াই দেওয়ার কথা ভাবতেও তৃণমূলকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।
আরও পড়ুন: মঞ্চে সৌরভ-পত্নী, হোমওয়ার্ক সঙ্গী করে অযোধ্যার পোশাকে পুজো-সূচনায় মোদী
অবশ্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, ১৫ নয়, সব মিলিয়ে বড়জোর ১০-১১টি আসনে গোর্খা বা নেপালিদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গুরুং তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলালেন বলেই সব গোর্খা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকবেন, এমনটা ভাবারও কারণ নেই।
প্রত্যাশিত ভাবেই গুরুং এবং তাঁর দল সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী পাহাড়ের দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পং আসনে। সমতলের ফাঁসিদেওয়া এবং কালচিনিও গোর্খাবহুল। শিলিগুড়ি ও ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতেও বেশ কিছু গোর্খা ভোট রয়েছে। এর মধ্যে গত লোকসভা ভোটে ১১টি আসনেই বিজেপি এগিয়েছিল। তৃণমূল আশা করছে, গুরুং সঙ্গে আসায় সেগুলি তারা বিজেপি-র থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে।
রাজ্য বিজেপি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা উত্তরবঙ্গের জোনাল ইনচার্জ সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘‘এই আসনগুলো ছাড়া অন্য কয়েকটা আসনেও গোর্খা ভোট রয়েছে। কিন্তু সেটা ২%-৩% করে। সেই ভোটও যে পুরোপুরি গুরুংয়ের নিয়ন্ত্রণে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। ফাঁসিদেওয়া এবং কালচিনির গোর্খারা গুরুংয়ের কথা শুনে চলবেন, তা-ও নয়।’’ তবে পাশাপাশিই তিনি মেনে নিয়েছেন, ‘‘গুরুং তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলানোয় দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পঙে নিশ্চয়ই তার প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু সমতল বা ডুয়ার্সের গোর্খা ভোটারদের উপরে গুরুংয়ের বা পাহাড়ের কোনও দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রথমত, গুরুং নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিজেই নষ্ট করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিন বছর ধরে পাহাড়ে যাঁকে দেখাই যায়নি, এখন পাহাড়ের ভোটেও তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কি না, তা-ও প্রমাণসাপেক্ষ।’’
একদা উত্তরবঙ্গের ওই আসনগুলিতে কংগ্রেস এবং সিপিএমের প্রভাব থাকলেও গত লোকসভা ভোটে সেখানে তাদের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আলিপুরদুয়ারে কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায়ের কথায়, ‘‘পাহাড়ে গুরুংয়ের একটা রবিনহুড ভাবমূর্তি ছিল। উনি তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ করে সেটা হারালেন। আর সমতল ওঁকে বরাবরই ভিলেন মনে করে। ওঁদের সমতলে ৩৭৬টা মৌজা চাওয়ার ফলেই সমতলে আদিবাসি বিকাশ পরিষদের উত্থান। গুরুং মমতার কাছাকাছি আসায় উল্টে উনি আদিবাসি ভোট হারাবেন! কুমারগ্রাম, কালচিনি, নাগরাকাটা, মাদারিহাট, মালবাজারে আদিবাসি ভোট বেশি। তবে তরাইয়ের দুটো আসনে গোর্খা ভোট বেশি আছে।’’
আরও পড়ুন: এ বারের ম্যাচ বাঁচানো কঠিন ক্যাপ্টেন ইমরানের, বলছে তামাম পাকিস্তান
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘উত্তরবঙ্গে হারানো জমি পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে অশুভ আঁতাত করলেন। যিনি গুরুংয়ের বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে অভিযোগ এনেছিলেন, তিনিই এখন গুরুংকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন, মমতা কি গোর্খাল্যান্ড নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন নাকি গুরুং গোর্খাল্যান্ডের দাবি ছেড়ে দেবেন!’’
যাদবপুরের সিপিএম বিধায়ক তথা বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘ওই ১১টি আসনের মধ্যে ২০১৬ সালে যেগুলি কংগ্রেস এবং বামেরা পেয়েছিল, সেগুলি আবার আমরাই পাব। কারণ, গুরুং বিজেপি-র দিকে যাওয়ায় তাঁর লোকজন বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিল। এখন তিনি তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। কিন্তু তাঁর লোকজন তো আবার তৃণমূলকেও পছন্দ করে না। ফলে সেই পুরনো ভোট আবার আমাদের দিকেই ফিরবে।’’
গত কয়েক বছরে মোর্চার নেতা-কর্মীরাই ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় বিজেপি-র পদাধিকারী হয়ে গিয়েছেন। পাহাড়ি দলের কোনও দাপুটে নেতা পাহাড়ে না থাকায় গত কয়েক বছরে আরএসএস-ও ওই অঞ্চলে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে বলে খবর। ফলে বিজেপি এখন গোর্খাদের মধ্যে আর পুরোপুরি ‘বহিরাগত’ দল নয়। তা ছাড়া গুরুং-তৃণমূল নৈকট্যের পর বিনয় তামাং, অনিত থাপারা কী করবেন, তা-ও এখনও স্পষ্ট নয়।