প্রতীকী ছবি।
‘‘লাও তো বটে! আনে কে?’’
রেল বিভাগের কাজকর্ম মনে পড়িয়ে দিচ্ছে শরৎচন্দ্রকে। আধুনিক প্রযুক্তির কোচ এসে পড়ে আছে। পুরনো প্রযুক্তির কোচের বদলে বিভিন্ন ট্রেনে সেগুলো জুড়বে কে? যথাসময়ে সেগুলো না-জুড়ে পুরনো কোচে ট্রেন ছুটিয়ে যাত্রীদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? সদুত্তর নেই।
২০১৮-র অক্টোবরে রায়বেরেলীর হরচন্দপুরে দিল্লিগামী নিউ ফরাক্কা এক্সপ্রেস বেলাইন হয়ে গিয়েছিল স্টেশনমাস্টারের পয়েন্ট সেটিংয়ের ভুলে। সেই দুর্ঘটনার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ময়নাগুড়ির বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনা। সে-বার পয়েন্ট সেটিংয়ে ভুলের জেরে অব্যবহৃত লাইনে ঢুকে পড়েছিল উত্তর রেলের নিউ ফরাক্কা এক্সপ্রেস। ন’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে মারা যান সাত যাত্রী, আহত ২১। তখন ওই ট্রেন ছুটত আইসিএফ কোচ নিয়ে। এখন সেই ট্রেনে এলএইচবি কোচ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তার প্রায় সমগোত্রের মালদহ-দিল্লি ফরাক্কা এক্সপ্রেস (পূর্ব রেল) ছুটছে আইসিএফের পুরনো কোচ নিয়েই। দেশে আইসিএফ কোচ উৎপাদন বন্ধ হয় ২০১৮-র ১৯ জানুয়ারি। তার পর থেকে দেশের সব জ়োনেই এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য এলএইচবি কোচ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ট্রেনে পুরনো আইসিএফ কোচ বদলে ধাপে ধাপে বসানো হচ্ছে এলএইচবি কোচ। কিন্তু সেই কাজে গতি নেই।
অভিযোগ, এলএইচবি কোচ এসে বিভিন্ন জ়োনে মাসের পর মাস পড়ে থাকা সত্ত্বেও রেক বদল করা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে, যাত্রীদের প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা নিয়েই ছুটছে বহু ট্রেন। শুধু উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলেই প্রায় ১৮০টি এলএইচবি কোচ এসে পড়ে রয়েছে। পূর্ব রেলের কাছে রয়েছে প্রায় ৫০টি কোচ। দক্ষিণ-পূর্ব রেলে ১৩০টিরও বেশি, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল ধাপে ধাপে রেক পরিবর্তনের কথা জানালেও কাজ তেমন এগোতে পারেনি। জমে থাকা কোচের সংখ্যাই সেটা বলে দিচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনে এলএইচবি কোচ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখনও ওই ট্রেনও ছুটছে পুরনো আইসিএফ কোচ নিয়ে।
কেন? রেল সূত্রের খবর, পুরনো আর নতুন কোচের বিন্যাসে মিলছে না। কোনও ট্রেনে কিছু পুরনো কোচ রেখে কিছু নতুন কোচ লাগানো যাচ্ছে না। বদলাতে হলে পুরো ট্রেনের সব কোচই বদলে ফেলতে হবে।
কিন্তু একটি ট্রেনে তো ২৪-২৫টি কোচ লাগে। পূর্ব-রেলে ৫০টি নতুন কোচ এসেছে। তা হলে সমস্যা কী?
রেলকর্তারা জানান, একটি ট্রেনে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রথম শ্রেণি, এসি টু টিয়ার, এসি থ্রি টিয়ার, স্লিপার কোচ থাকে। ৫০টি নতুন কোচের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে, স্লিপার আছে ২৫টি। বাকি ২৫টি এসি থ্রি টিয়ার। ফলে সেগুলো দিয়ে একটি ট্রেনের সব কোচ বদলে ফেলা যাচ্ছে না। ফলে ২৪ কোচের পুরো ট্রেনের ‘ফর্মেশন’ বা গঠন-কাঠামো আটকে যাচ্ছে।
করুণ রসিকতা করে রেলের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কারও টুপি আছে তো জামা নেই। কেউ প্যান্ট পেয়েছেন তো জুতো নেই। কেউ জুতো, প্যান্ট, টুপি পেয়ে জামার অপেক্ষায় বসে আছেন। এমনই তালগোল পাকানো পরিস্থিতি নিয়ে লড়ে যেতে হচ্ছে।’’ উদাহরণ হিসেবে কর্তারা জানান, কোনও একটি ট্রেনের এসি কোচের প্রয়োজন অনুযায়ী জোগান থাকলেও দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত সংখ্যায় স্লিপার এবং সাধারণ কামরা নেই। এই সমস্যাতেই থমকে রয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের রূপান্তর।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের খবর, তাদের ৪৩টি ট্রেন এলএইচবি-তে পরিবর্তিত হয়েছে। আরও চারটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও কাজে হাত দেওয়া যায়নি। পূর্ব রেলে ফরাক্কা, জামালপুর, জম্মু-তাওয়াই, হাওড়া-বারমের এক্সপ্রেস মিলিয়ে প্রায় সাতটি ট্রেনের রেক পরিবর্তনের অনুমোদন মিলেছে। সেই জন্য প্রায় ১৫০টি কোচ দরকার। প্রয়োজনের তুলনায় কোচ কম থাকায় রেক বদলানো যাচ্ছে না সেখানে। তা ছাড়া সাধারণ আইসিএফ কোচের তুলনায় প্রতিটি এলএইচবি কোচের দৈর্ঘ্য ১.৭ মিটার বেশি। তাতে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণেও সমস্যা হচ্ছে। সারা দেশে কমবেশি সব জ়োনেই এই সমস্যা রয়েছে। রেলের এক কর্তা বলেন, “সব জ়োনকে নিয়ে হিসেব করলে সারা দেশে পড়ে থাকা এলএইচবি কোচের সংখ্যা কয়েক হাজার। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী ওই কোচ বণ্টনের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না-থাকায় পুরনো ট্রেনের কোচ বদল আটকে যাচ্ছে। ফলে কোচ উৎপাদনে ঘাটতি না-থাকলেও উপযুক্ত সংখ্যায় রেক বদল করা যাচ্ছে না।’’