রবিবার বিজেপিতে যোগদানের পরে ধূপগুড়িতে প্রচারে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে মিতালি রায়। — নিজস্ব চিত্র।
আপাত নিস্তরঙ্গ উপনির্বাচনের ঠিক ৪৮ ঘণ্টা আগে উত্তেজনার পারদ চড়ল মগডালে। ধূপগুড়িতে উপনির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা পরের প্রশ্ন, কিন্তু প্রচারের শেষলগ্নে তুল্যমূল্য লড়াইয়ে একে অপরকে টেক্কা দিতে সর্বস্ব চেষ্টায় কসুর করল না শাসকদল তৃণমূল এবং বিজেপি। প্রবল ভাবে লড়াইয়ে রইলেন কংগ্রেস সমর্থিত বাম প্রার্থীও।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ধূপগুড়ি কেন্দ্রে জয়লাভ করেছিলেন বিজেপি প্রার্থী বিষ্ণুপদ রায়। ৪,৩৫৫ ভোটে বিজেপি প্রার্থী হারিয়েছিলেন তৃণমূলের মিতালি রায়কে। সেই বিষ্ণুপদেরই মৃত্যুতে ধূপগুড়িতে উপনির্বাচন করাতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। আর ভোটের প্রচারে নিজেদের উজাড় করে দিলেন রাজনৈতিক দলের তাবড় নেতারা। যদিও গেরুয়া শিবিরের দাবি, উপভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে তৃণমূলকে মোক্ষম জবাব দেওয়া গিয়েছে। ঘটনাচক্রে, শনিবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচার করতে গিয়েছিলেন ধূপগুড়িতে। তাঁর সেই মঞ্চে হাজির ছিলেন ২০২১ সালে বিষ্ণুপদের কাছে হার স্বীকার করা মিতালিও। জনসভা শেষের ১২ ঘণ্টার মধ্যে সেই মিতালিকেই বিজেপির পতাকা হাতে দলে যোগ দেওয়ালেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। গৈরিক পতাকা হাতে নিয়ে এতদিন জয় বাংলা, জয় মমতা স্লোগানে সভা মাত করা মিতালি গর্জে উঠলেন, জয় শ্রীরাম স্লোগানে। শনিবার মিতালির উপস্থিতিতেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন দীপেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। দীপেন্দ্র জলপাইগুড়ি জেলা বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি। এই প্রেক্ষিতে মিতালিকে ছিনিয়ে নিয়ে তৃণমূলকে মোক্ষম জবাব দিল বিজেপি, এমনই দাবি গেরুয়া শিবিরের। যদিও মিতালির প্রবেশ বা প্রস্থানে ধূপগুড়ির রাজনীতিতে কোনও প্রভাবই পড়বে না বলে দাবি তৃণমূলের। অন্য দিকে, ধূপগুড়ির প্রচার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বাম এবং কংগ্রেস নেতারাও। একাধিক জনসভায় আশাতীত সাড়া মিলেছে বলে দাবি একদা সিপিএমের অভেদ্য দূর্গ বলে পরিচিত ধূপগুড়ির বামমহলের।
এ বারের উপনির্বাচনে আলোচনার বিষয়বস্ত হয়ে উঠেছে ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণার দাবি। অভিষেক শনিবারই কার্যত ঘোষণা করে গিয়েছেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ধূপগুড়ি ব্লককে পৃথক মহকুমা হিসাবে ঘোষণা করা হবে। তাতেই আরও জোর পেয়েছে মহকুমা-জল্পনা। বস্তুত, শুক্রবারই আধ ঘণ্টা আলো নিভিয়ে মোম জ্বালানোর ডাক দেওয়া হয়েছিল। শহরকে নিষ্প্রদীপ রাখার ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মেলায় বিষয়টি আরও গতি পেয়েছে রাজনৈতিক আলোচনা। সব মিলিয়ে ভোটের ঠিক দু’দিন আগে আচমকাই টগবগে উত্তেজনা উত্তরের ছোট্ট শহর ধূপগুড়িতে।
মিতালির দলত্যাগ
২০২১ সালে বিজেপি প্রার্থী বিষ্ণুপদের কাছে হারতে হয়েছিল তৃণমূলের মিতালিকে। সেই মিতালিকে এ বার উপনির্বাচনে টিকিট দেয়নি তৃণমূল। তার বদলে তৃণমূল প্রার্থী করে পেশায় অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র রায়কে। আর মিতালি সেই ক্ষোভে ভোটের ঠিক ৪৮ ঘণ্টা আগে যোগ দেন বিজেপিতে। রবিবার সকালে তাঁর হাতে পদ্মপতাকা তুলে দেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত। একে তৃণমূলের কাছে বড় ধাক্কা হিসাবে অভিহিত করেন তিনি। দাবি করেন, আগামিদিনে মিতালির পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই বিজেপিতে যোগ দেবেন। যদিও একে আদৌ ধাক্কা বলে মানতে চায় না তৃণমূল। শাসকদলের নেতা জয়প্রকাশ মজুমদারের দাবি, মিতালির দলত্যাগে ধূপগুড়ির রাজনীতিতে কোনও প্রভাব পড়বে না। আর মিতালি নিজে বলছেন, ‘‘বিজেপির প্রতি আমার কোনও টান নেই। তৃণমূল তিন বছর ধরে আমাকে ঘরে বসিয়ে রেখেছে। না সংগঠন, না প্রশাসন— আমাকে কোনও কাজেই লাগানো হয়নি। কাজ করতে চাই বলে বিজেপিতে এসেছি। এটাই বাস্তব, এখানে ইমোশনের কোনও জায়গা নেই।’’ মিতালির আরও দাবি, তাঁর সমস্ত খবর সম্পর্কেই মুখ্যমন্ত্রী অবহিত। তিনি বলছেন, ‘‘দিদি এখন ব্যস্ত। আমাদের মতো লোকেদের সঙ্গে কথা বলার মতো সময় ওঁর নেই। দিদি যখন সারা পশ্চিমবঙ্গের খবর রাখেন, তখন আমার খবর নিশ্চয়ই তাঁর কাছে আছে। দল সবই জানে।’’ মিতালি আরও দাবি করছেন, দু’দিন আগে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ধূপগুড়িতে প্রচারে এসে জনসভা থেকে প্রকাশ্যে মিতালির খোঁজ করেছিলেন। তার পরেই তৃণমূল নড়েচড়ে বসে। তাঁকে জোর করে প্রচারে নামানো হয়। অভিষেক তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু শনিবার মঞ্চে আগাগোড়া হাজির থেকে অভিষেককে উত্তরীয় পরিয়েও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কোনও কথা বলতে পারেননি মিতালি। তার পরেই দলবদলের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেন মিতালি। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের আমাকে আর প্রয়োজন নেই। উপনির্বাচনেও টিকিট দেয়নি। শুভেন্দুদা আমার খোঁজ করার পর দু’দিন প্রচারে নামিয়েছিল। গত কাল (শনিবার) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাতেও ছিলাম। শুনেছিলাম, আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনও কথা বলেননি।’’ এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, মিতালির দলবদলের কতটা প্রভাব পড়বে ধূপগুড়ির উপনির্বাচনে?
ধূপগুড়ি মহকুমা হবে?
ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণার দাবি আজকের নয়। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে প্রচারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আশ্বাস দিয়েছিলেন ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণার। কিন্তু এখনও সেই দাবি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ধূপগুড়িবাসী। এরই মধ্যে গত শুক্রবার ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণার দাবিতে শহরকে নিষ্প্রদীপ রাখার ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মিলেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও মানুষ আলো জ্বালাননি। শহর জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোমবাতি হাতে নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েন ধূপগুড়িবাসী। আর তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধূপগুড়ির ফণীর মাঠের জনসভায় দাঁড়িয়ে অভিষেক কার্যত ঘোষণাই করে দিয়েছেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মহকুমা তকমা পাবে জলপাইগুড়ি জেলার এই জনপদ। যদিও তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও দানা বেধেছে। বিরোধীদের প্রশ্ন, অভিষেক রাজ্য সরকারের কোন পদে রয়েছেন যে, তিনি জনসভা থেকে ধূপগুড়িকে মহকুমা করার কথা ঘোষণা করে দিচ্ছেন! প্রত্যাশিত ভাবেই এই খোঁচাকে গুরুত্ব দেয়নি তৃণমূল। তাঁদের পাল্টা দাবি, বিজেপির জমানা শেষ। উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর বিপুল জয়েই স্বীকৃতি পাবে অভিষেকের মন্তব্য। তার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে মহকুমা ঘোষণার পর হবে বিজয় উৎসব।
ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণা নিয়ে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যের সমালোচনা করলেও তা নিয়ে অবশ্য ভিন্ন সুর নেই কোনও দলেরই। বাম, কংগ্রেসও ধূপগুড়িবাসীর মহকুমা-দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একই কথা বিজেপিরও। শুক্রবারের স্বতঃস্ফূর্ত মোমবাতি প্রতিবাদই কি এর নেপথ্যে? উত্তর মিলবে ৮ সেপ্টেম্বর ভোটবাক্স খোলার পর। কারণ, মহকুমা ঘোষণা করার বিষয়টি যে এ বারের ভোটে বড় প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে তা অস্বীকার করতে পারছে না কোনও রাজনৈতিক দলই।
শেষদিনের প্রচারে ঝড়
রবিবার ছিল ধূপগুড়িতে শেষ দিনের প্রচার। সেই প্রচারে ঝড় তুলল সব পক্ষই। এক দিকে গেরুয়া শিবিরের হয়ে দূর্গ আগলাতে হাজির হলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু থেকে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত। তেমনই তৃণমূলের তরফে প্রচারে তুফান তুলতে কলকাতা থেকে হাজির হলেন ফিরহাদ হাকিম, মিমি চক্রবর্তীরা। প্রসঙ্গত, মিমি একাধারে জলপাইগুড়ির মেয়ে অন্য দিকে তাঁর তারকা ভাবমূর্তি। এই দুয়ের মিশেলে কি ধূপগুড়িতে ঘাসফুলের ঝড় তোলা যাবে? জোড়াফুল শিবিরের দাবি, ধূপগুড়ি পুনর্দখল এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। আর বিজেপির নেতাদের দাবি, ব্যবধান কতটা বাড়বে তা নিয়েই এখন শেষ মুহূর্তের আলোচনা চলছে। মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন কংগ্রেস সমর্থিত বাম প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র রায়ও। হিসাব বদলের স্বপ্নে তিনিও বিভোর।