দার্জিলিঙের ম্যালে অনশনে ভারতী তামাঙ্গ। রবিবার।
গোর্খা লিগের প্রয়াত নেতা মদন তামাঙ্গের খুনে অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে রবিবার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দার্জিলিঙের ম্যাল চৌরাস্তার হাওয়াঘরে আমরণ অনশন শুরু করলেন তাঁর স্ত্রী ভারতী তামাঙ্গ। ভারতীদেবী গোর্খা লিগের সভানেত্রীও। তবে অনশন আন্দোলনে তিনি ব্যক্তিগত ভাবেই নেমেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। হওয়াঘরের চারদিকে অবশ্য ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের ব্যানার, পোস্টার ঝোলানো হয়েছে।
অনশন শুরুর মিনিট কুড়ির মধ্যে পুলিশ যায় ভারতীদেবীর কাছে। পুলিশ তাঁকে অনশন তুলে নেওয়ার কথা বললে ফ্রন্টের কর্মী, সমর্থকদের সঙ্গে তাঁদের কথা কাটাকাটিও হয়। কিন্তু ভারতীদেবী অনশন চালিয়ে যাওয়ার দাবিতে অনড় ছিলেন। পুলিশ শেষ পর্যন্ত পিছু হটে। এর পরে এলাকায় বিরাট পুলিশ বাহিনী ও সিআরপিএফ জওয়ানদের মোতায়েন করা হয়েছে। হাওয়ামহলে রাতে আলোর ব্যবস্থা করেছেন ভারতীদেবীর সঙ্গীরাই। চারপাশ ঘিরে দেওয়া হয়েছে। যেখানে তিনি বসেছিলেন, সেখানেই রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়েন ভারতীদেবী। ম্যাল চৌরাস্তায় নজরদারি চালাচ্ছেন পুলিশ ও সিআরপিএফ-এর জওয়ানেরা। হাওয়ামহলের মধ্যেই রয়েছেন ডেমোক্রাটিক ফ্রন্টের অনেক নেতা কর্মী। পাহাড়ে এখন পর্যটন মরসুম। এর মধ্যেই ভারতীদেবীর অনশনে অস্বস্তিতে মোর্চা নেতৃত্ব। সিবিআই-র চার্জশিট ভিত্তি করে আদালত যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তাতে মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ, সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি-সহ ২৩ জনের নাম রয়েছে। সেই সঙ্গে এই সপ্তাহেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই দিনের পাহাড় সফরে আসার কথা রয়েছে। এই অবস্থায় বিভিন্ন মহলে চাপ বাড়াতেই ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের তরফে ভারতীদেবীকে সামনে রেখে অনশন আন্দোলনের কৌশল নেওয়া হয়েছে।
অনশনে বসার আগে দার্জিলিঙে মিছিলে ভারতী তামাঙ্গ।
যদিও ভারতীদেবী বলেছেন, ‘‘আমি স্বামীর খুনের ঘটনার বিচার চাই। আদালত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে। অথচ সিবিআই কী করছে, বুঝতে পারছি না। এই জন্য কাউকে বিরক্ত না করে আমি নিজের মতো সুবিচার চেয়ে ম্যালের এক কোণে অনশনে বসেছি। এর মধ্যে তো কোনও অন্যায় নেই।’’ এদিন রাতে গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি নিজের ফেসবুকে অনশনের বিষয়টি জানিয়েছে পাহাড়-সহ সব স্তরের মানুষের সমর্থন চেয়েছেন। গোর্খা লিগের নেতারা জানিয়েছেন, ২০১০ সালের ২১ মে মদন তামাঙ্গ প্রকাশ্যে দিনের আলোয় ক্লাব সাইড রোডে খুন হন। ৫ বছর কেটে গিয়েছে। এখন মামলা একটা জায়গায় পৌঁছেছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তার পরেও সিবিআই হাত গুটিয়ে কেন বসে আছে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
পাহাড়ের অনশনের রাজনীতি অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। আশির দশকে ঘিসিঙ্গের আমলেও অনশন আন্দোলন হয়েছে। আবার পার্বত্য পরিষদ থেকে ঘিসিঙ্গকে সরানোর দাবিতে শিলিগুড়ি লাগোয়া শালবাড়িতে বিমল গুরুঙ্গেরা অনশন করেছিলেন। পাহাড়ের মোর্চার আন্দোলনে বিভিন্ন সময় আমরণ, রিলে অনশনও হয়েছে। তেমনই, লেপচারাও কালিম্পং থানার পাশেই ডম্বরচকে অনশনে বসেছিলেন।
সন্ধ্যায় মোর্চার সহকারী সাধারণ সম্পাদক জ্যোতিকুমার রাই বলেন, ‘‘গোটা বিষয়টি বিচারাধীন। আইন আইনের পথে চলছে। আমরাও আদালতে অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করছি। এর মধ্যে অনশন বসাটা চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া কিছু নয়। এতে তো ম্যালে সাধারণ মানুষ, পর্যটকদের অসবিধা হবে।’’
এ দিন অনশন শুরুর আগে দার্জিলিঙের ‘গোর্খা দুঃখ নিবারক সম্মেলনে’র হলঘরে ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের একটি বৈঠক হয়। সেখানে গোর্খা লিগ ছাড়াও সিপিআরএম, জিএনএলএফ, সিকিম-দার্জিলিং একীকরণ মঞ্চের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তার পরে ফ্রন্টের সদস্যরা ভারতীদেবীকে সামনে রেখে মোমবাতি হাতে মৌন মিছিলও করেন। দুই শতাধিক ফ্রন্ট সমর্থকদের মিছিল চৌরাস্তায় এসে পৌঁছানোর পর ভারতীদেবী অনশনে বসেন। ধীরে ধীরে এলাকায় ভিড়ও বাড়ে। আবার রবিবার ছুটির দিনে পযর্টকরা ম্যালে ভালই ঘোরাঘুরি করেছেন। অনশন শুরু হতেই অনেকে সেদিকেই এগিয়েও যান। তবে পুলিশ এবং সিআরপিএফ জওয়ানদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরে ম্যাল অনেকটাই ফাঁকাই হয়ে যায়।
দার্জিলিঙের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুর্যপ্রতাপ যাদব পুলিশ কর্মীদের নিয়ে ভারতীদেবী অনশন তুলে নেওয়ার অনুরোধ করতে এসেছিলেন। পরে এএসপি বলেন, ‘‘আমরা ভারতীদেবী অনুরোধ করি, অনশন তুলে নেওয়ার জন্য। এলাকাটি এমন যে এতে সাধারণ মানুষ তো বটেই পর্যটকদেরও সমস্যা হবে। আর পুরো বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। আবার আগামী দিনে সরকারি অনুষ্ঠানও রয়েছে হাওয়াঘরে। ওঁরা রাজি হননি।’’ ডেমোক্রাটিক ফ্রন্টের মুখপাত্র শঙ্কর হাং সুব্বার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘পুলিশের আচরণ ঠিক ছিল না। এটা কোনও দলের কর্মসূচি না। একজন মহিলা তাঁর স্বামীর খুনিদের ধরার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনশন করছেন। ঘটনাচক্রে তিনি একটি দলের নেত্রী। তাই আমরা এসেছি। পুলিশ অনশন তুলতে চাইছে, আমাদেরও সকলকে গ্রেফতার করুক। আমরা জেলে গিয়ে অনশন করব।’’
ছবি: রবিন রাই