ফাইল চিত্র
গত বছর বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরে যে কথা বলেছিলেন, বুধবার বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে শিল্পপতিদের সামনে সেই বার্তাই স্পষ্ট করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, সামাজিক উন্নয়নে যেটুকু সম্ভব, করেছেন। তৃতীয় দফায় রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরে তাঁর পাখির চোখ শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানই। তবে বিনিয়োগ টানতে শুধু পরিকাঠামো, এক-জানলা ব্যবস্থা কিংবা লগ্নিবান্ধব পরিবেশ নয়, তাঁর বাজি সম্প্রীতি, সামাজিক ক্ষমতায়ন, কল্যাণ প্রকল্পও।
বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সহযোগিতায় প্রস্তুত রাজ্য সরকার। তাঁর দাবি, এখানে বন্ধ বা ধর্মঘটে কর্মদিবস একটিও নষ্ট হয় না। ঘাটতি নেই মেধারও। শিল্পমহলের একাংশ যদিও মনে করে দেশের সর্বত্র বড় লগ্নির খরা। কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে এখনও পুরোদস্তুর ছন্দে ফেরেনি অর্থনীতি। এই অবস্থায় বিনিয়োগ টানা মুখের কথা নয়। তার জন্য জমি-জট, লাল ফিতের ফাঁস কাটিয়ে কড়া হাতে সিন্ডিকেটের মতো সমস্যা দমন একান্ত জরুরি।
দু’বছর পরে রাজ্যে বসল এই শিল্প সম্মেলনের আসর। এ দিন তার শুরুর দিকেই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পে নতুন পাঁচ লক্ষ মহিলা উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন মমতা। বার্তা, সামাজিক ক্ষমতায়নে সরকারি পদক্ষেপের। সেই সঙ্গে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন, এ রাজ্যে পণ্য-পরিষেবার চাহিদা যথেষ্ট।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, আট স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজ্যের উন্নয়ন। পরিকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মূলধনী বিনিয়োগ, বাণিজ্যে সরলীকরণ, প্রশাসনিক সরলীকরণ এবং ধর্মঘট বিরোধী অবস্থান। এই ‘পোক্ত ভিতের’ উপরেই লগ্নি টেনে শিল্পায়নের ইমারত তৈরির আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাম আমলে যেখানে বছরে ৭৫ লক্ষ কর্মদিবস নষ্ট হত, সেখানে এখন সেই উদাহরণ নেই। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘(করোনা-কালে) কেন্দ্রে জিডিপি যেখানে নেগেটিভ, সেখানে রাজ্যের জিএসডিপি পজ়িটিভ।’’
উদ্বোধনী মঞ্চে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় মন্তব্য করেছিলেন, বিনিয়োগকারীরা চান রাজনৈতিক স্থিরতা, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ প্রশাসন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং আইনের শাসন। মমতার বক্তব্য, ‘‘কিছু দলের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আমরা বিভাজনে বিশ্বাস করি না। আমরা মানুষ-জাতি-ধর্ম বিভাজন করি না। এখানে আমরা পরিবারের মতো থাকি। গুজরাত, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব—যা-ই বলুন, বাংলায় থাকলে, আপনি আমার পরিবারের মানুষ। আমাদের শিল্পযাত্রা শুরু হয়েছে। আপনারা আস্থা, ভরসা, বিশ্বাস রাখুন।’’
তাঁর সংযোজন, ‘‘ধর্মীয় একতা, মন্দির-মসজিদ, গুরুদ্বার, গির্জা সব একসঙ্গে আছে। তা দেখতে রাজ্যে আসুন।’’
ভোট-পর্বে ‘বহিরাগত’-বিতর্কের সাক্ষী থেকেছে এই রাজ্য। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী এক দিকে যেমন ভিন্ রাজ্যের শিল্পপতিদের মন থেকে সে বিষয়ে সংশয় দূর করতে চেয়েছেন, তেমনই শান দিয়েছেন তাঁর সর্বভারতীয় ভাবমূর্তিতে। তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে, ‘কেম ছো’, ‘ভানক্কম’-এর মতো ভিন্ ভাষার শব্দবন্ধ।
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, অমৃতসর থেকে ডানকুনি পর্যন্ত ইস্টার্ন ফ্রেট করিডর হচ্ছে। ২৪৮৩ একর জমি পুরুলিয়ায় বরাদ্দ রয়েছে শিল্পের জন্য। জঙ্গলমহল সুন্দরী কর্মনগরী প্রকল্পে ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। ২০২৩ সালে বাংলা যুক্ত হবে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে। ডেউচা-পাঁচামিতে প্রায় এক লক্ষ লোকের কাজ হবে, বিনিয়োগ হবে ১২ হাজার কোটি টাকা। তাঁর কথায়, তথ্যপ্রযুক্তিতে ২৮০০ সংস্থা কাজ করেছে এ রাজ্যে। সিলিকন ভ্যালিতে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও তাদের অনুসারী সংস্থাগুলিকে জায়গা দেওয়া হবে। ডানকুনি-রঘুনাথপুর, ডানকুনি-কল্যাণী এবং ডানকুনি-হলদিয়া শিল্প ফ্রেট করিডর হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে বলেছেন অশোকনগরে তেল উত্তোলন, দিঘার কেব্ল ল্যান্ডিং স্টেশন, পর্যটন শিল্পে জোর, পাওয়ারলুম ক্ষেত্রে পৃথক নীতি তৈরির কথাও। স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড় দিয়ে আবাসন শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার কথা মনে করিয়েছেন তিনি।
মমতার আহ্বান, ‘‘বাংলাকে শিল্পে এক নম্বর করে তুলুন। কর্মসংস্থান বাডুক। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সরকার সব রকম সহযোগিতা করবে। যা জমি প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা হবে। বিদ্যুৎ পর্যাপ্ত। শিল্প প্রোমোশন বোর্ড তৈরি হয়েছে শিল্পমহলের সুবিধার্থে।... শিল্প এবং কর্মসংস্থান আমার গন্তব্য।’’
মানুষের হাতে টাকা গেলে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। চাঙ্গা হয় চাহিদা। লাভ হয় শিল্পেরও। সম্ভবত সেই যুক্তি মাথায় রেখেই সরাসরি সরকারি পরিষেবা পৌঁছনোর কথাও এ দিন তুলে ধরেছেন মমতা। দাবি করেছেন, সরকারি প্রকল্পগুলি থেকে ৯৫% মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
বিরোধীরা যদিও প্রশ্ন তুলেছেন, প্রতি বারই বিপুল অঙ্কের লগ্নি আসার দাবি করার পরেও গত ১০ বছরে ক’টি নতুন কারখানার উদ্বোধন করতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী? সত্যিকারের লগ্নি এসেছে কত টাকার? তাতে চাকরিই বা হয়েছে ঠিক কত জনের?
এ দিন আন্তর্জাতিক শিল্প-বাণিজ্য মহলের সঙ্গে রাজ্যের আলোচনা সভা পরিচালনা করছিলেন অমিত মিত্র। পরে মুখ্যমন্ত্রীও সেই আলাপচারিতায় যোগ দেন। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকান কূটনীতিবিদদের এ রাজ্যে উৎপাদন শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে আরও লগ্নির আহ্বান জানান। ব্রিটেনের কূটনীতিবিদকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, সে দেশের সঙ্গে এ রাজ্যের সম্পর্কের আরও উন্নতির জন্য তিনি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও কলকাতা পুরসভার মেয়রকে সেখানে পাঠাবেন। মাসাইমারা সাফারিতে মুখ্যমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত কেনিয়ার প্রতিনিধি।