Murshidabad Unrest

‘ফুরফুরে বিকেল, সুন্দর চা’, ছবি পোস্ট বহরমপুরের তৃণমূল সাংসদ পঠানের! ‘খবরাখবর রাখেন?’ ধেয়ে যাচ্ছে প্রশ্নবাণ

মুর্শিদাবাদে অশান্তির সূত্রপাত গত মঙ্গলবার থেকে। শুক্রবার সেখানে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। ঘটনাচক্রে সে দিনই ‘ফুরফুরে’ মেজাজি পোস্ট সাংসদ পঠানের।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:০০
Share:
photo of Yusuf Pathan

চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ছবি পোস্ট করেছেন বহরমপুরের তৃণমূল সাংসদ ইউসুফ পঠান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

গাছগাছালিতে ঢাকা শান্ত পরিবেশ। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তিনি। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত বহরমপুর কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ তথা ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পঠান। নিরালায় দাঁড়িয়ে মনোরম বিকেলটিকে উপভোগ করছিলেন। চায়ের কাপে চুমুকও দিয়েছিলেন। কিন্তু ইনস্টাগ্রামে তা পোস্ট করতেই বিতর্কের আগুন যেন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। কারণ, পঠানের সংসদীয় এলাকার জেলা তত ক্ষণে অগ্নিগর্ভ। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ এবং তৎপরবর্তী অশান্তিতে মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছে। বেসরকারি সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদের হিংসায় অন্তত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বহরমপুরে অশান্তি হয়নি ঠিকই, কিন্তু তা ছড়িয়েছে সুতি, শমসেরগঞ্জ, ধুলিয়ান এবং জঙ্গিপুরে। এই পরিস্থিতিতে সাংসদের ‘আরামের বিকেল’-কে ভাল চোখে দেখছেন না অনেকেই। তাঁর পোস্টের নীচে একে একে ধেয়ে যাচ্ছে প্রশ্নবাণ— ‘‘মুর্শিদাবাদের খবরাখবর রাখেন?’’

Advertisement

মুর্শিদাবাদে অশান্তির সূত্রপাত গত মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল থেকে। ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে কর্মসূচিতে প্রথম হিংসা ছড়ায় জঙ্গিপুরে। তার পর ধীরে ধীরে সেই অশান্তির আঁচ পৌঁছোয় সুতি, শমসেরগঞ্জের দিকেও। মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। শুক্রবার হিংসা সামাল দিতে পুলিশ চার রাউন্ড গুলি চালায়। সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার জানান, দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে তাঁরা এখন বিপন্মুক্ত। কারও মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি পুলিশ। ঘটনাচক্রে ওই দিনই, অর্থাৎ শুক্রবার ইনস্টাগ্রামে চায়ের পোস্টটি করেন ইউসুফ। মোট তিনটি ছবি দেন তিনি। সঙ্গে লেখেন— ‘‘ফুরফুরে বিকেল, সুন্দর চা আর শান্ত পরিবেশ। মুহূর্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছি।’’ পোস্টের সঙ্গে একটি ইংরেজি গানও জুড়ে দেন।

ইউসুফ পঠানের পোস্ট করা আরও একটি ছবি।

ইউসুফ পঠানের পোস্ট করা আরও একটি ছবি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

ইউসুফের এই পোস্টের পর বিরোধীরা একযোগে আক্রমণ শানিয়েছেন। এমনকি, তৃণমূলের অন্দরেও কেউ কেউ ‘বহিরাগত’ সাংসদকে কটাক্ষ করছেন। তাঁকে যখন বহরমপুরের পাঁচ বারের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড় করানো হয়েছিল, তখন অনেকেই বলেছিলেন, বাইরে থেকে এই ধরনের তারকারা পশ্চিমবঙ্গে এসে ভোটে জিততে পারেন, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই মানুষের সঙ্গে থাকেন না। কখনওই গ্রামবাংলার সঙ্গে ‘একাত্ম’ হয়ে উঠতে পারেন না। ‘বহিরাগত’ হয়েই থেকে যান। অশান্তির মাঝে ইউসুফের পোস্টও আরও এক বার বলে দিল, মুর্শিদাবাদ থেকে তিনি আদতে অনেক দূরেই। শারীরিক এবং মানসিক ভাবেও। সেখানে কী ঘটছে, তা আদৌ তৃণমূল সাংসদ জানেন কি না, অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। রাজ্য বিজেপির সাংসদ তথা প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘‍ইউসুফ পাঠান কে? একজন ক্রিকেটার। কোনও রাজনীতিক তো নন। তাঁকে বহরমপুরে তৃণমূল কেন টিকিট দিয়েছিল? শুধু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়টাকে ব‍্যবহার করার জন্য। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই ইউসুফের সঙ্গে রাজনীতির বা মুর্শিদাবাদ জেলার সাধারণ মানুষের জীবনের তাপ-উত্তাপের কোনও সম্পর্ক নেই। সমাজমাধ‍্যমে পোস্ট হওয়া ছবি থেকেই সেটা পরিষ্কার। তৃণমূল শুধুমাত্র মুসলিম ভোটব‍্যাঙ্ক সংহত রাখার জন‍্য রাজনীতি করে। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার জন‍্য রাজনীতি করে না। তার প্রমাণ হচ্ছে মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে নির্বাচিত সাংসদের এই ছবি।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সমাজমাধ্যমে লেখেন, ‘‘মালদহ-মুর্শিদাবাদে অশান্তির আবহে তৃণমূলের সাংসদ চায়ে চুমুক দেওয়ার ছবি পোস্ট করছেন! বাঙালিদের প্রতিনিধি হিসাবে বহিরাগতদের আনা হলে এটাই হয়। লজ্জাজনক।’’

Advertisement

ইউসুফ বা তাঁর পোস্ট নিয়ে মন্তব্যই করতে চাননি অধীর। আনন্দবাজার ডট কমকে তিনি সাফ বলে দেন, ‘‘এই সব নিয়ে মন্তব্য করার রুচিবোধ আমার নেই।’’ মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মালদহ দক্ষিণে আমাদের কংগ্রেসের সাংসদ ইশা খান চৌধুরী রয়েছেন। গতকালই আমি তাঁকে শমসেরগঞ্জে যেতে বলেছিলাম। রবিবার ইশা সেখানে গিয়েছেন। তাঁকে একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করছেন।’’ অধীরের আরও বক্তব্য, ‘‘মুর্শিদাবাদে যা হয়েছে, গোটাটার নেপথ্যে রয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। কোনও ধর্মপ্রাণ মানুষের এ সব নিয়ে উৎসাহ নেই। কিছু লুম্পেন, গুন্ডাদের দিয়ে এটা করানো হয়েছে। এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে।’’ মঙ্গলবার অধীর নিজে শমসেরগঞ্জ যাবেন বলে জানিয়েছেন।

ইউসুফ পঠানের পোস্ট করা আরও একটি ছবি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

পঠানের লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। রাখঢাক না করেই তিনি বলেছেন, ‘‘আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না ইউসুফ পঠানের হয়ে ভোট করাতে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বহরমপুরের মানুষের দুর্ভাগ্য। একজন খেলোয়াড় ভোটে জিতেছেন ঠিক কথা। কিন্তু তিনি মানুষের সুখ-দুঃখে থাকছেন না। মানুষ যখন সঙ্কটে, তিনি তখন মস্তি করে বেড়াচ্ছেন।’’

ইউসুফের পোস্টকে তেমন গুরুত্ব দিতে নারাজ রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মুর্শিদাবাদের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন। কোনও সংসার যাতে ভেসে না-যায়, সেটাই এখন সবাইকে দেখতে হবে। আমাদের সকলের সেটা কর্তব্য। কে কোথায় দুধ-চা খাচ্ছেন, ছবি দিচ্ছেন, তাঁর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করে আমি নিজের সম্মান এবং ঐতিহ্যকে ছোট করতে পারব না। মানুষের পাশে আমরা আছি, কংগ্রেস আছে।’’

তৃণমূল সাংসদকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি সিপিএম। তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ইউসুফ পঠানের মতো ফুলবাবুরা মানুষের জন্য রাজনীতি করেন না। তাই তাঁদের কোনও তাপ-উত্তাপও নেই। তাঁরা ভোটের ময়দানে আসেন, রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। তৃণমূল এই সংস্কৃতি বাংলায় চালু করেছে। বিজেপি-ও তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই হিংসায় শহর, গ্রাম জ্বলছে। আর তৃণমূলের সাংসদ ইনস্টাগ্রামে চা খাচ্ছেন।’’

প্রায় সবার বক্তব্যেই একটি বিষয় পরিষ্কার। রাজনীতির বৃত্তের বাইরে থেকে আসা তারকা ভোটে দাঁড়িয়ে জেতেন বটে, কিন্তু এঁদের বড় অংশই দৈনন্দিন রাজনীতি থেকে, সাংগঠনিক রাজনীতির সংস্কৃতি থেকে মানসিক ভাবে দূরেই থেকে যান। ইউসুফ আর এক বার দেখালেন। অবশ্য তাঁর এই পোস্টের নীচে নিন্দা যেমন আছে, অনেকে পোস্টটি ‘লাইক’ও করেছেন। এমনকি, তাঁদের মধ্যে সচিন তেন্ডুলকরও রয়েছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement