শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ১১৯তম জন্মদিনে বঙ্গ বিজেপি আয়োজিত ভার্চুয়াল র্যালিতে বিজেপি সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা। ছবি: পিটিআই।
দলের প্রাণপুরুষের জন্মদিন। গোটা দেশে সোমবার শ্যামাপ্রসাদ স্মরণ করছে বিজেপি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জন্য সে আয়োজন হল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে। কেন্দ্রীয় বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এ দিন ভার্চুয়াল র্যালি করলেন বাংলার জন্য। শিক্ষা ক্ষেত্রের অবনতি, রাজনীতিকে অপরাধ জগতের হাতে তুলে দেওয়া, শুধুমাত্র পদ আঁকড়ে থাকার লোভে অন্য সব কিছুর সঙ্গে আপস করার অভিযোগ তুলে বাংলার বর্তমান শাসকদের তীব্র আক্রমণ করলেন বিজেপি সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা। শ্যামাপ্রসাদের বাংলাকে আবার আগের গৌরবের স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প নিন, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে এ দিন এমনই আহ্বান রাখলেন তিনি।
বিজেপি যে দলের উত্তরসূরি, সেই জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিক যাত্রাপথই ছিল এ দিনের ভাষণে নড্ডার মূল আলোচ্য। কলকাতা থেকে এ দিনের ভার্চুয়াল র্যালিতে যোগ দিয়েছিলেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ, জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায়, কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ, রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় সিংহরা। আর দিল্লির মঞ্চে নড্ডার সঙ্গে ছিলেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় ও দেবশ্রী চৌধুরী, রাজ্যসভার সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত, দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তারা। তবে শ্যামাপ্রসাদের এই ১১৯তম জন্মদিনে বঙ্গ বিজেপি আয়োজিত ভার্চুয়াল র্যালিতে নড্ডাই ছিলেন প্রধান বক্তা। এবং প্রায় ৪৫ মিনিটের ভাষণের সুবাদে তিনিই ছিলেন এ দিনের দীর্ঘতম বক্তাও।
স্বাভাবিক কারণেই জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতার মহিমা কীর্তন দিয়েই ভাষণ শুরু করেন নড্ডা। কিন্তু বিজেপির সভাপতির ভাষণ এ দিন যত এগোল, ততই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রশংসা এ দিন যে সব প্রসঙ্গে করলেন নড্ডা, সেই প্রতিটি প্রসঙ্গই আসলে তিনি টেনে আনলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের আক্রমণ করার জন্য। শিক্ষাক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের অবদান, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্যামাপ্রসাদের ভালবাসা, আদর্শের জন্য যে কোনও পদ বা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে দ্বিধা না করা, আঞ্চলিক উন্নয়নের ভাবনা, জাতীয়তাবোধ— মূলত এই সব প্রসঙ্গেই এ দিন জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন নড্ডা। আর এই প্রতিটা বিষয় নিয়ে নাম না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলকে তিনি এ দিন আক্রমণ করেন।
বিজেপির গায়ে যে হেতু ‘বাঙালি বিরোধী’ তকমা লাগানোর চেষ্টা করে তৃণমূল, সে হেতু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামটাকে আগের চেয়েও অনেক বেশি করে তুলে ধরার রাস্তা নিয়েছে বিজেপি। বাঙালি বিরোধী হওয়া তো দূরের কথা, বিজেপি আসলে এক বাঙালির দেখানো পথই অনুসরণ করে— এই বার্তাই এখন বার বার দেওয়ার চেষ্টা করে বিজেপি। কলকাতা বন্দরের নামও ইতিমধ্যেই বদলে শ্যামাপ্রসাদের নামে করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। স্বাধীনতার সময়ে পাকিস্তানের অংশ হতে চলেছিল যে অবিভক্ত বঙ্গ, তাকে ভেঙে পশ্চিমবঙ্গকে ভারতে রেখে দিতে পারার নেপথ্যে শ্যামাপ্রসাদের সক্রিয়তা কতটা ছিল, সে কথাও গত কয়েক মাস ধরে অত্যন্ত জোর দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ দিবসে এবং তার পরে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুদিনে বিজেপি নেতারা সে সব নিয়ে জোরদার প্রচার চালিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিজেপির সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো ছিল। এ বার শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিনে আরও জোর গলায় সেই একই কথা বললেন নড্ডা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় না থাকলে পশ্চিমবঙ্গ আজ ভারতের মানচিত্রে থাকত না, বললেন তিনি। শুধু বাংলা নয়, অবিভক্ত পঞ্জাবের একটা বড় অংশকে ভারতে রেখে দিতে পারার কৃতিত্বও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরই, মনে করালেন নড্ডা। আর বললেন, ‘‘পাকিস্তান যদি ভারতকে ভেঙে থাকে, তা হলে শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন এমন একজন, যিনি পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়েছিলেন।’’
আরও পড়ুন: পুলিশকে বোমা মারার হুমকি আদিবাসী নেতার, ডাক দিলেন দ্বিতীয় হুল
এই প্রসঙ্গ ছেড়েই নড্ডা ক্রমশ ঢুকে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতির সমালোচনায়। বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা এক সময়ে কতটা সামনের সারিতে ছিল এবং তাতে শ্যামাপ্রসাদের অবদান কতটা ছিল, ব্যাখ্যা করেন নড্ডা। তার পরেই আক্ষেপের সুরে বলেন, সেই বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে একবার দীক্ষান্ত ভাষণ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং বাংলায় ভাষণ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন— বলেন নড্ডা। তাঁর কথায়, ব্রিটিশের শাসনে থাকা ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশীয় ভাষায় দীক্ষান্ত ভাষণ হবে, এ কথা তখন ভাবাই যেত না। শ্যামাপ্রসাদের এই সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ভালবাসার উদাহরণ, ব্যাখ্যা বিজেপি সভাপতির। নড্ডার কথায়, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ... বাংলা সে সময়ে গোটা দেশকে দৃষ্টি দিয়েছে। কিন্তু আজ যখন শিক্ষার কথা বলি আর বাংলার বর্তমান নেতৃত্বকে দেখি, তখন দুঃখ হয়।’’ বিজেপি সভাপতি বলেন, ‘‘এটা আমাদের সঙ্কল্প যে, শ্যামাপ্রসাদের বাংলাকে শিক্ষাক্ষেত্রে আবার প্রতিষ্ঠিত করব।’’
আরও পড়ুন: ৭৫ শতাংশ বেসরকারি চাকরি সংরক্ষিত রাজ্যবাসীর জন্য, খসড়া প্রস্তাব পাশ হরিয়ানায়
পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে ক্রমশ গলা চড়াতে থাকা মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট সরকারে থাকবেন না বলে বাংলার অর্থমন্ত্রী পদ থেকে ১৯৪২ সালে শ্যামাপ্রসাদ পদত্যাগ করেছিলেন এবং নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতায় স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাও তিনি ছেড়ে দেন— এ দিন বলেন নড্ডা। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কখনও পদকে গুরুত্ব দেননি। তিনি শুধুমাত্র আদর্শকে গুরুত্ব দিতেন। আদর্শের জন্য নিজের জীবন দিয়েছিলেন।’’ এর পরেই নাম না করে তৃণমূলের প্রতি বিজেপি সভাপতির কটাক্ষ, ‘‘আজ পশ্চিমবঙ্গে পদ ছাড়া আর কিছুই নেই। পদের জন্য যে কোনও আপস করতে এরা তৈরি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে দুষ্কৃতীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’’
কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অসহযোগিতার রাস্তা নিয়ে চলছে বলে মন্তব্য করে এ দিন তোপ দেগেছেন জে পি নড্ডা। কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প বাংলায় চলতে না দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তাঁর অভিযোগ— রাজ্যের বর্তমান শাসকরা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মানেন না। বিরোধী দলকে বাংলায় রাজনীতি করতে দেওয়া হচ্ছে না, ভুয়ো মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে, মাদকের মামলা দেওয়া হচ্ছে, বিজেপি নেতাদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, বিজেপি সাংসদদের গৃহবন্দি করে রাখা হচ্ছে— অভিযোগ নড্ডার। বাংলায় কান পাতলেই এখন ‘কাটমানি, কাটমানি, কাটমানি’ শোনা যায়, কটাক্ষ তাঁর। সে কথার সঙ্গে মিলিয়েই নড্ডার আহ্বান, ‘‘কাট দি সাইজ অব দিজ লিডারস ইন কামিং টাইমস (আগামী দিনে এই সব নেতাদেরকে আকারে ছোট করে দিন)।’’
এ ভাবেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সোমবার বিজেপি সভাপতি তীব্র আঘাত হানতে চেয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ স্মরণের মঞ্চ থেকেই। আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য লড়ার পাশাপাশি জাতীয়তাবোধ, শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে দুটোই সমান ভাবে ছিল বলে নড্ডার দাবি। এখন যাঁরা বাংলা শাসন করছেন, তাঁদের মধ্যে দুটোর একটাও নেই বলে তাঁর অভিযোগ। শ্যামাপ্রসাদের বাংলাকে শিক্ষাক্ষেত্রে আবার প্রতিষ্ঠিত করা, বাংলার গৌরবান্বিত সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বাংলার রাজনীতিকে ‘দুষ্কৃতী-মুক্ত’ করা— এই লক্ষ্যে সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছে বিজেপি। বলেছেন নড্ডা।