সূর্যকান্তের স্ত্রীর সংস্থায় তল্লাশি, সিপিএম বলছে প্রতিহিংসা

রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বর্তমানে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর স্ত্রীর পরিচালনাধীন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে বুধবার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে তল্লাশি চালাল রাজ্য পুলিশ। ২০১২ সালেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছিল তদন্ত কমিটি। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে খাকুরদার অফিসে এ দিনের তল্লাশির পরে সিপিএমের অভিযোগ, এটা শাসক দলের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া কিছু নয়। তৃণমূলের তরফে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০৪:০৪
Share:

ঊষা মিশ্রের (ডান দিকে) স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় তল্লাশি।

রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বর্তমানে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর স্ত্রীর পরিচালনাধীন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে বুধবার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে তল্লাশি চালাল রাজ্য পুলিশ। ২০১২ সালেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছিল তদন্ত কমিটি। পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে খাকুরদার অফিসে এ দিনের তল্লাশির পরে সিপিএমের অভিযোগ, এটা শাসক দলের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া কিছু নয়। তৃণমূলের তরফে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

Advertisement

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুধবার বলেন, “তল্লাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কেন হবে? এটা তো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ব্যাপার। নিশ্চয়ই তদন্তকারীরা তথ্যপ্রমাণ পেয়েই তল্লাশি করেছেন।”

সূর্যবাবুর স্ত্রী ঊষা মিশ্রর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি এড্স নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজের বরাত পেয়েছিল ২০০৮ সালে। সে সময় রাজ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন সূর্যকান্তই। তিন বছর পরে, রাজ্যে ক্ষমতায় এসে ওই সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে তদন্ত শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। বছরখানেক পরে তার রিপোর্ট এলেও এত দিন পরে কেন তল্লাশি চালানো হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে সিপিএম। ঊষাদেবী নিজে অভিযোগ করছেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়েই তদন্ত শুরু করেছে সরকার। এখন সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন চলছে। সামনেই পুরভোট। তার আগে বিরোধী দলনেতার গায়ে কালি ছেটাতেই এই তল্লাশি।” তাঁর দাবি, “এর আগে আমার মেয়ে রোশেনারার বিরুদ্ধে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে হার ছিনতাইয়ের অভিযোগ করা হয়েছিল। আমার দেওর তপন মিশ্রের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ এনে অবসরকালীন সুবিধা ও পেনশন আটকে রাখা হয়েছিল।” সিপিএমের অন্য এক নেতার বক্তব্য, “এই সম্মেলন থেকে সূর্যদার রাজ্য সম্পাদক হওয়ার কথা। তাই তাঁর গায়ে কালি লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে।”

Advertisement

উল্টো দিকে প্রশাসনের একটি সূত্রের দাবি, দুর্নীতি দমন শাখার মামলা দায়ের করতে হলে রাজ্যপ্রশাসনের শীর্ষস্তরের অনুমতি নিতে হয়। সম্প্রতি সেই অনুমতি পাওয়ার পরেই মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেই কারণেই সময় লেগেছে। দুর্নীতি দমন শাখার প্রধান রামফল পওয়ারকে ফোনে বারবার চেষ্টা করেও অবশ্য এ নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য জানা যায়নি। মুখে কুলুপ এঁটেছেন স্বাস্থ্য কর্তারাও।

ঊষাদেবীর সংস্থার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? ২০০৮ সালে এড্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সমিতির একটি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভগবতী দেবী নারী কল্যাণ সমিতিকে। দিঘা-শঙ্করপুর এলাকায় ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের মধ্যে এড্স সচেতনতা বাড়ানোই ছিল প্রকল্পের লক্ষ্য। বরাদ্দ ছিল প্রায় ২৮ লক্ষ টাকা। সরকার বদলের পর ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়ে রাজ্য। ২০১২ সালের মাঝামাঝি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা পড়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের কাছে। তাতে বলা হয়, প্রকল্পে ৯৮% যৌনকর্মী থাকার কথা বলা হলেও তার সঠিক তথ্য মেলেনি। ওই অঞ্চলে অন্য যে সব সংস্থা এই ধরনের কাজ করত, তাদের বদলে কল্যাণ সমিতিকে কেন কাজের বরাত দেওয়া হয়, তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কাজের বরাত পাওয়ার আগে স্বাস্থ্য দফতরের যে ‘জয়েন্ট অ্যাপ্রাইজাল কমিটি’ সংস্থাটি পরিদর্শন করেছে, তাদের রিপোর্টেও ‘ওভাররাইটিং’ মিলেছে। অ্যাপ্রাইজাল কমিটির সুপারিশে কল্যাণ সমিতির নাম ছিল না বলেও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট। এ দিন সুশান্তবাবু বলেন, “ওই সংস্থার জন্য যে টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, তার সব হিসাবও পাওয়া যায়নি।” সরকারি সূত্রে খবর, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট এড্স প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল সোসাইটি’র অভিযোগের ভিত্তিতেই সংস্থার সচিব ঊষা মিশ্র-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখা। প্রতারণা (৪২০), জালিয়াতি (৪৬৮), আর্থিক তছরূপ (৪০৯) এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের (১২০বি) ধারায় এই মামলা করা হয়।

এ দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ ওই সংস্থার অফিসে হানা দেয় দুর্নীতি দমন শাখার চার সদস্যের একটি দল। অফিসের অদূরেই সূর্যবাবুদের পারিবারিক বাড়ি। তখন ঊষাদেবী ছিলেন কলকাতার কড়েয়া রোডে সূর্যবাবুর সরকারি আবাসনে। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেওর সিদ্ধার্থ মিশ্র-সহ কল্যাণ সমিতির কয়েক জন কর্মীর সামনে ফাইলপত্র খতিয়ে দেখেন দুর্নীতি দমন শাখার কর্তারা। সন্ধ্যা পর্যন্ত তল্লাশি চলে। পরে সিদ্ধার্থবাবু বলেন, “তদন্তকারীরা প্রথমে আমার ঘরে এসে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঘরের চাবি খুলে দিতে বলেন। নিরাপত্তারক্ষীকে দিয়ে চাবি খোলানো হয়। দু’টি আলমারি এবং বেশ কিছু ছোট লকার খুলে তল্লাশি চালানো হয়।” সিদ্ধার্থবাবু জানান, সংস্থার বিল-ভাউচার, সদস্যপত্র, অডিট রিপোর্টের বেশ কিছু কাগজ-সহ প্রায় ৩০টি ফাইল তদন্তকারীরা নিয়ে গিয়েছেন।

সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে ঊষাদেবীর বক্তব্য, ২০০৮ সালের ওই প্রকল্পটি তিন বছর ধরে চলেছিল। পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ২৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২৫ লক্ষ টাকা ‘অ্যাকাউন্ট পেয়ি’ চেকে খরচ করা হয়েছে। বাকি টাকা বিদ্যুতের বিল, কর্মীদের ভ্রমণ ভাতা-সহ বিবিধ খাতে খরচ করা হয়েছে। “এ সব অডিট রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছিল, কোথাও কোনও গরমিল ধরা পড়েনি। কর্মী নিয়োগের ব্যাপারটি ন্যাকো-র অফিসারেরা দেখতেন। তাতেও নিয়ম ভাঙা হয়নি,” দাবি ঊষাদেবীর।


ঊষা মিশ্রের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কার্যালয়ের সামনে ভিড়।

কিন্তু সূর্যবাবু স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কেন স্বাস্থ্য-বিষয়ক কাজের বরাত তাঁর স্ত্রীর পরিচালনাধীন এনজিও পাবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের কিছু কর্তা। এ বিষয়ে সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “এড্স নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে কোন সংস্থা কাজ পাবে, তা ঠিক করে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাকো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে এর জন্য আমার সুপারিশের প্রয়োজন হয়নি। এই সংক্রান্ত ফাইলও আমার কাছে আসেনি। বুঝছি না আমাকে কেন দায়ী করার চেষ্টা হচ্ছে।” তবে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, ঊষাদেবীর সংস্থার কাজ পাওয়ার ব্যাপারে হয়তো সূর্যবাবুর কোনও ভূমিকা নেই, কিন্তু তাঁর স্ত্রীর সংস্থা যাতে প্রকল্পের কাজ না পান, তা তাঁর দেখা উচিত ছিল। এ বিষয়ে ঊষাদেবীর মন্তব্য, “আমার স্বামী রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলে আমি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে পারব না? আমাদের সংস্থা তো অনেক আগে থেকেই এড্স নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। আমি শুধুই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী, আমার নিজস্ব পরিচিতি নেই?”

অনেক বাম নেতা দাবি করছেন, ক্ষমতায় এসেই সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে তদন্তের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল নতুন সরকার। পরে তা নিয়ে নবান্ন-কর্তাদের মুখে আর কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। এখন তাঁরা সূর্যবাবুর স্ত্রীকে নিশানা করতে চাইছেন। প্রশাসনেরও একটি অংশ স্বীকার করছেন, স্ত্রীর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে আসলে সূর্যবাবুকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছে সরকার।

সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম এ দিন বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই বলেছিলেন সিপিএমের নেতা ও তাঁদের পরিবারের লোকেদের জেলে পাঠাবেন। তিনি সবাইকে জেলে পাঠাতে পারেননি। কিন্তু নানা ভাবে হেনস্থার চেষ্টা করেছেন।” তাঁর অভিযোগ, সূর্য মিশ্রকে জনসমক্ষে হেয় ও অপদস্থ করার জন্যই তাঁর স্ত্রীর সংস্থার দফতরে তল্লাশি চালানো হয়েছে। সিবিআই মুখ্যমন্ত্রীর দলের আয়-ব্যয়ের তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়ায় প্রতিহিংসা মেটাতে এই কাজ করা হয়েছে।

পার্থবাবুর প্রতিক্রিয়া, “প্রতিহিংসা দেখাতে চাইলে তো আমরা তো ক্ষমতায় এসেই এটা করতে পারতাম! ২০১১ সালে তো অভিযোগ করিনি!”

তবে এ দিন কল্যাণ সমিতিতে তল্লাশি চলছে এই খবর চাউর হতেই কিছু গ্রামবাসী সেখানে এসে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের অনেকেই তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। তাঁরা স্লোগান দেন, ‘মমতা যদি ডাকাতরানি হয়, ঊষা মিশ্র কীসের রানি?’

—নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement