এ তল্লাটে মন্ত্রীরও বিপক্ষে যায় ‘উন্নয়ন’। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, এই ‘উন্নয়ন’ দলেরই একাংশের বাহিনী। সে বাহিনী মোটরবাইকে গিয়ে মন্ত্রীর অনুগামীদের বলেছে, ‘ভোটে দাঁড়াতে হবে না’। এবং মন্ত্রীর পছন্দের লোকেদের ভোটে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। পূর্ব বর্ধমানের এই তল্লাট—মঙ্গলকোট। মন্ত্রী—স্থানীয় বিধায়ক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী।
তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সিদ্দিকুল্লা দেখা করেছিলেন অনুগামীদের টিকিট না-পাওয়া নিয়ে কথা বলতে। অনুগামীদের ভাগ্য না বদলানোর ক্ষোভে তিনি বলছেন, ‘‘মাওবাদীরা ঠান্ডা। দার্জিলিঙে মানুষ নিশ্চিন্ত। মঙ্গলকোটে কী এমন বিষ রয়েছে বলুন তো!” পার্থের বক্তব্য, ‘‘আগে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। আমার ধারণা, সমস্যা নেই। নতুন কিছু হলে, ফের কথা বলব।’’
বাম জমানায় তাদের দাপটে মঙ্গলকোটে কংগ্রেস বা তৃণমূল মাথা তুলতে পারেনি বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তৃণমূলের আমলে, বিশেষ করে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের সময় থেকে মঙ্গলকোট দেখছে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এক দিকে সিদ্দিকুল্লা। অন্য দিকে, অপূর্ব চৌধুরী, মঙ্গলকোট ব্লকের তৃণমূল সভাপতি।
এলাকায় শোনা যায়, অপূর্ব বনাম সিদ্দিকুল্লা দ্বন্দ্বে গত দু’বছরে বোমাবাজি থেকে খুন—সবই হয়েছে মঙ্গলকোটে। তৃণমূলের শিমুলিয়া অঞ্চল সভাপতি ডালিম শেখ খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে মন্ত্রীর ভাই রহমতুল্লা চৌধুরীর। সম্প্রতি দু’গোষ্ঠীর গোলমালের পরে এলাকায় গেলে আমডোবে মন্ত্রীর গাড়িতে যে ঝাঁটার বাড়ি পড়েছিল, তৃণমূল অন্দরের খবর, তা ওই বিরোধেরই জেরে।
এমনিতে মঙ্গলকোট-সহ গোটা কাটোয়া মহকুমাতেই এ বার কোনও ভোট হচ্ছে না। কারণ, পঞ্চায়েতের তিন স্তরের কোনও আসনেই বিরোধী প্রার্থী নেই। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসকদলের ‘সন্ত্রাস’-এর জন্যই এই হাল। তা হলে সিদ্দিকুল্লার এক জন অনুগামীও টিকিট পেলেন না কেন? মঙ্গলকোট ব্লকের ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯৮টি সংসদ ও পঞ্চায়েত সমিতির ৪৩টি আসনের মধ্যে ৩৯টিতে পছন্দের লোকজনকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু মনোনয়ন প্রক্রিয়া চলার সময়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘দুষ্কৃতীরা বোমা-পিস্তল নিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: জিতেও বোর্ড গড়া যাবে কি? বিনাযুদ্ধের ৩৪% ঘিরে সংশয়
অনুগামীদের দাবি, লাখুরিয়া, চানক, ঝিলু ১ ও ২, মঙ্গলকোট সদরের মতো এলাকায় অপূর্ববাবুর অনুগামীদের মোটরবাইক বাহিনীর ছড়ানো ‘আতঙ্কের’ দিকেই ছিল মন্ত্রীর আঙুল। এক অনুগামীর কথায়, ‘‘বীরভূমে উন্নয়ন রাস্তায় নেমে বিরোধীদের রুখেছে। এখানে আটকেছে দলের লোককেই।’’ টিকিট না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ অনুগামীদের হাতে কলকাতার মন্ত্রী-আবাসনে ঘেরাও হন সিদ্দিকুল্লা। সরকারি গাড়ি ও নিরাপত্তারক্ষী ছাড়েন মন্ত্রী। এমনকী, মন্ত্রিত্ব ছাড়ার কথাও বলেন দলের অন্দরে। কাজ হয়নি তার পরেও।
দলের মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করার পরেও সিদ্দিকুল্লা বলছেন, ‘‘শীর্ষ নেতৃত্ব আমাকে ৩৯টি আসনে প্রার্থী দিতে বলেছিলেন। অনুব্রত মণ্ডল (বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি এবং মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম, আউশগ্রামের দলীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত) নিজের হাতে টিকিট দিলেন। তার পরেও বাধা পেল আমার প্রার্থীরা!’’ মোটরবাইক বাহিনী নামিয়ে মন্ত্রী-পক্ষকে ভয় দেখানোর অভিযোগ উড়িয়ে অপূর্ববাবু বলেন, ‘‘মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠেরা পঞ্চায়েতের দু’-একটা আসনে প্রার্থী হতে লালায়িত নন। সবাই আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।’’ বিতর্কিত ৩৯-এর কয়েক জনও তাঁদের শিবিরে চলে এসেছেন, এমনই দাবি অপূর্ব-অনুগামীদের।
মনোনয়ন শেষ। আপাতত মঙ্গলকোট শান্ত। তাই মন্ত্রীকে অনুব্রত মণ্ডলের পরামর্শ, ‘‘উনি মন দিয়ে উন্নয়ন করুন। সংগঠন দেখে কাজ কী!’’ তৃণমূল শিবিরের এ খবর অজানা নয় বিরোধীদের। বিজেপির জেলা পর্যবেক্ষক অনল বিশ্বাসের মন্তব্য, ‘‘মন্ত্রী নিজেই এত উন্নয়ন দেখেছেন, উনি এখন প্রকৃত উন্নয়ন করতে গিয়েও না ভয় পান।’’ (চলবে)