লাথি-চড়: সোমবার তৃণমূলের লাঠি-বাহিনী এ ভাবেই বর্ধমানের কার্জন গেট এলাকার দখল নিয়েছিল বলে অভিযোগ। ছবি: সুপ্রকাশ চৌধুরী
বীরভূমের জেলা পরিষদের ৪২টি আসনের মধ্যে ৪১টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে চলেছে তৃণমূল। বাঁকুড়া জেলা পরিষদের ৪৬টি আসনের মধ্যে ২৬টিতেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনও প্রার্থী নেই। আরও কোনও প্রার্থী প্রত্যাহার না হলে লড়াই হবে ২০টি আসনে।
এ রাজ্যের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, গত আট বছরে সন্ত্রাস, রিগিং, ভোট লুঠের খেলায় তৃণমূল নতুন কিছু করতে পারেনি। সিপিএমের দেখানো পথেই ‘আদর্শ’ ছাত্রের ভূমিকায় থেকেছে তারা। তবে এ বার বীরভূম-বাঁকুড়া জেলা পরিষদ ভোটের আগেই তৃণমূল জিতে নেওয়ার পর সেই বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, ‘‘এ যা হল তা ৩৪ বছরের সিপিএম জমানাতেও হয়নি।’’
কেমন সেই চিত্র?
বীরভূম প্রশাসন জানিয়েছে, সোমবার মনোনয়নের শেষ দিনে রাজনগরের একটি আসন ছাড়া আর কোনও আসনে প্রার্থী-ই দিতে পারেনি বিরোধীরা। আর ব্লক-ভিত্তিক হিসেব বলছে, ১৯টি ব্লকের মধ্যে ভোট হবে শুধু মহম্মদবাজার, নলহাটি, রাজনগর এবং ময়ূরেশ্বর ১ ও ২-এ।
তৃণমূলের দাবি, বিষ্ণুপুর মহকুমার ছ’টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং বাঁকুড়া সদরের পাঁচটি সমিতিতে কোনও নির্বাচন হবে না। এই পরিসংখ্যান সামনে আসতেই দ্বিতীয়বার জেলা পরিষদ দখলের আনন্দে মিষ্টি-আবির নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন দুই জেলার নেতাকর্মীরা।
আরও পড়ুন: শাসকের মাথাব্যথা বাড়তি মনোনয়ন
বিরোধীদের দাবি, মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের কার্যালয় ঘিরে শাসকদলের ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে ছিল। দোসর ছিল জেলা পুলিশ, প্রশাসন। ফলে মনোনয়ন জমা দিতে গেলে রক্তারক্তি হত। ভোটে দাঁড়ানোর চেয়ে প্রাণরক্ষায় আগে বলে মনে করছেন বিরোধীরা। প্রশাসনের একটি সূত্রে জানাচ্ছে, ৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাঁকুড়ায় মনোনয়ন সংক্রান্ত হিংসার ঘটনা ঘটেছে ২০টি। এক জম মারা গিয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০। বীরভূমে ১১টি সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অনেকে।
কেষ্টবরণ: সোমবার পর্যন্ত বীরভূম জেলা পরিষদের ৪২টির মধ্যে ৪১টি আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি বিরোধীরা।
সিউড়িতে জেলা পার্টি অফিসে অনুব্রত মণ্ডলকে আবির দিচ্ছেন মহিলা কর্মীরা। পরে অবশ্য
মনোনয়ন জমার সময় বেড়ে মঙ্গলবার বিকেল তিনটে পর্যন্ত করা হয়েছে। নিজস্ব চিত্র
এ সব কথায় অবশ্য কিছু এসে যায় না বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের। এ দিন তিনি বলেন,‘‘উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় বিরোধীরা মনোনয়ন দিতে পারেননি। যেখানে ভোট হবে সেখানে মশারি খাটিয়ে রাখছি। একটি মশাও গলতে পারবে না।’’ বীরভূমে রাজনগর থেকে জেলা পরিষদের একটি মাত্র আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিজেপি প্রার্থী চিত্রলেখা রায়। তাঁর কথায়, ‘‘উন্নয়নে আস্থা নেই বলেই তো রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড় করাতে হল। গণতন্ত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেন হবে না বলতে পারেন?’’ বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় বলছেন, ‘‘অনুব্রতর দাদাগিরি সত্ত্বেও বিজেপি বাড়ছে। মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার দর্প মানুষই ভাঙবেন।’’ একই দাবি সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদারও। মনসা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘গত পঞ্চায়েত ভোটেও তৃণমূল বাধা দিয়েছিল। কিন্তু, জেলা পরিষদের বহু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। বিরোধীরা ১৮টি আসনে জিতেওছিল। এ বার তো আস্ত জেলা পরিষদই ছিনিয়ে নিল!’’
বাঁকুড়ার পরিস্থিতি নিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদক অজিত পতি বলেন, ‘‘ব্লক ও মহকুমাশাসকের দফতর ঘিরে শাসকদল ও পুলিশের ব্যাপক সন্ত্রাসের জন্য আমাদের প্রার্থীরা ঢুকতেই পারেননি।’’ একই অভিযোগ বিজেপির বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিবেকানন্দ পাত্রের। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার ইচ্ছে মতো প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিল।’’ যা শুনে বাঁকুড়া জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘উন্নয়নের অস্ত্রে বিরোধীরা একেবারেই কুপোকাত। ওরা সংগঠনের ভিতটাই গড়ে তুলতে পারেনি। তাই প্রার্থীও দিতে পারেনি।’’
২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার জয়পুর, কোতুলপুর, বিষ্ণুপুর ও পাত্রসায়র ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেননি। তবে জেলা পরিষদের বেশির ভাগ আসনেই সে বার বামেরা লড়েছিল। সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, সে বার বাঁকুড়া জেলা পরিষদের ৪৬টি আসনের মধ্যে ৪৫টিতেই লড়াইয়ে ছিলেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা। ৫টি আসনে জয়ীও হন তাঁরা।