‘উন্নয়ন’কে এ ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোটের পালা শুরু হওয়ার পর থেকেই এ বার গেল-গেল রব উঠেছে কলকাতার বিদ্বজ্জন মহলে। ওই গেল রে, গণতান্ত্রিক স্বশাসন গেল, দরিদ্রের উন্নয়নে অংশিদারিত্ব গেল, সহভাগী পরিকল্পনা গেল। রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তির উদ্বোধন’ থেকে প্রমোদ দাশগুপ্তের ‘সক্রিয় গণউদ্যোগ’ থেকে অমর্ত্য সেনের ‘প্রান্তবাসীর সক্ষমতা’, সব মিশে গেল ধুলোয়। বিরোধীদের পিটিয়ে পাট করে দিলে পঞ্চায়েতি রাজের আর রইল কী?
কিন্তু গ্রামের মানুষ কী বলছেন? তাঁদের অনেকে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। মুর্শিদাবাদের মানুষ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিরোধীদের মনোনয়ন জমা পড়েনি, এতে তাঁরা স্বস্তিতে। নির্বাচন হলে লাশ পড়ত, গুন্ডাদের দাপাদাপি সইতে হত। সেই সঙ্গে তাঁদের গলায় তাচ্ছিল্যের সুর। যে-ই আসুক পঞ্চায়েতে, করবে তো দুটো রাস্তা, আর চারটে আলো। আর দেদার চুরি করে ফাঁক করবে। তার জন্য এত ঝামেলায় কাজ কী?
সাদাসাপ্টা কথা। উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বরং মনে প্রশ্ন উস্কে দেয়। বিরোধীদের মেরে তাড়ালে মানুষের ভোটাধিকার অর্থহীন হয়ে যায়, সে আপত্তিটা নয় বোঝা গেল। কিন্তু পঞ্চায়েতের যেটা কাজ, নিজের এলাকার উন্নয়ন, গ্রামের মানুষের সহায়তা, তার জন্য কি বিরোধীদের প্রয়োজন আছে?
আচ্ছা, এক মিনিটের জন্য চিন্তা করা যাক, বিধানসভায় কোনও বিরোধী নেই। কেমন হবে তা হলে? কোনও আলোচনা ছাড়াই আইন পাশ হবে। কোনও প্রশ্ন না-উঠেই পাশ হবে বাজেট। সরকারি দফতরগুলো কেমন কাজ করছে, তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবে বিধায়কদের যে সব স্থায়ী কমিটি, তাতে থাকবে কেবল সরকারপক্ষের বিধায়করা। সরকার মানুষের টাকা কী ভাবে খরচ করল, তা খতিয়ে দেখার জন্য যে ‘পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’, তার শীর্ষে থাকার কথা বিরোধী নেতার। সরকার পক্ষেরই লোক সেখানে বসে থাকলে তারা প্রশ্ন তুলবেই বা কেন, কাকেই বা তলব করবে। বিধানসভার কাজটাই স্রেফ লোক দেখানো হয়ে পড়বে, তার সাংবিধানিক দায়িত্ব একটা ছেলেখেলা হয়ে যাবে।
তা হলে জেলা পরিষদ বিরোধীহীন থেকে কাজ করবে কী করে?
এ প্রশ্নটা বামফ্রন্টকে ভাবিয়েছিল। তখন নব্বই দশকের গোড়ার দিক, সিপিএমের দাপট সর্বত্রগামী। তখনও নির্বাচনে কম সন্ত্রাস, রিগিং হয়নি। কিন্তু তারই সঙ্গে দেখা যায়, পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে বিরোধীদের মান্যতা দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে। ১৯৯৪ সালে পঞ্চায়েত আইন সংশোধন করা হল। নতুন নিয়ম এল, প্রতিটি জেলায় তৈরি হবে জেলা কাউন্সিল। সেটা কাজ করবে বিধানসভার ‘পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’-র মতো। তার নেতৃত্বে থাকবেন বিরোধী নেতা। কেবল জেলা পরিষদ নয়, যে কোনও পঞ্চায়েত সমিতি বা প্রাম পঞ্চায়েতের অ্যাকাউন্টও পরীক্ষা করতে পারবে কাউন্সিল।
এই নজরদারির কাজটা আরও পোক্ত করতে ২০০৩ সালে ফের আইন সংশোধন করে জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পূর্ত, কৃষি প্রভৃতি মোট দশটি স্থায়ী সমিতি তৈরি হল। নিয়ম হল, তাতে অন্তত এক জন বিরোধী নেতা থাকবেন। সদস্যদের মধ্যে ভোটাভুটিতে নির্বাচিত না হলে মনোনীত করতে হবে। একেবারে তৃণমূলস্তরেও বিরোধীর স্থান তৈরি করা হয়েছিল। স্থির হল, গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে প্রতিটি সংসদে তৈরি করা হবে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। এই সমিতিতে অন্যতম সদস্য হবেন ওই সংসদের নিকটতম ভোটে পরাজিত প্রার্থী। গ্রামে উন্নয়নের পরিকল্পনায় বিরোধীরও মতদানের সুযোগ থাকবে।
তখন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র। ভদ্রলোক তাঁর এলাকায় অবিসংবাদিত নেতা এবং আমলাদের প্রিয়পাত্র হলেও, রাজ্যবাসীর কাছে বিশেষ পপুলার নন কখনওই। ভাবলেশহীন মুখ, তেরছা কথা, তাচ্ছিল্যের ভাবভঙ্গি তাঁর গায়ে কখনও ‘জনদরদী’ লেবেল উঠতে দেয়নি। আর ছিলেন ‘আলিমুদ্দিনের পঞ্চায়েতমন্ত্রী’ বলে পরিচিত মদন ঘোষ। দলের নেতা হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে বিরোধীদের প্রতি তাঁরা খুব সহিষ্ণু ছিলেন কি না, সে ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ঘটনা এই যে, পঞ্চায়েতি রাজের প্রশাসনিক পরিকাঠামোয় বিরোধীদের পাকাপোক্ত জায়গা তৈরির আর্কিটেক্ট এঁরাই। বাকি বাম নেতাদের আগ্রহ ছিল না।
পঞ্চায়েত থেকে বিরোধীরা মুছে গেলে উন্নয়নের সুফল আদৌ আম আদমি পর্যন্ত পৌঁছবে তো? —ফাইল চিত্র।
কেন এমন উদ্যোগ? সে সময়ে যে সরকারি আধিকারিকরা এঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছিলেন, তাঁরা বলেন, স্থানীয় স্বশাসনের যে ধারণাকে বামফ্রন্টের একাংশ বরাবর লালন করেছে, সেই আদর্শের প্রতি আনুগত্য থেকেই এই পরিবর্তন। সূর্যবাবুর ‘গড়’, পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে বাস্তবিকই গ্রামবাসীর যোগদানে পরিকল্পনা ও বাজেট তৈরির কাজটা হাতে-কলমে হচ্ছিল।
আবার প্র্যাকটিকাল দিকটাও রয়েছে। ১৯৯১ সালে পঞ্চায়েতমন্ত্রী হওয়ার আগে সূর্যবাবু জেলা পরিষদের সভাধিপতিত্ব করেছিলেন। তা থেকেও হয়তো বুঝেছিলেন, বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিরোধীকেও জড়িয়ে নিতে না পারলে শাসকদলের কাজ চালানো মুশকিল হয়।
সমস্যা এল অন্য দিক থেকে। তৃণমূলস্তরে গ্রামের মানুষ নিজেরাই টাকা বরাদ্দ করছে, খরচ করছে, হিসেব দিচ্ছে, সেটা অনেক নেতা মেনে নিতে পারেননি। আর বিরোধীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, সেই আইডিয়াটা জেলা বা ব্লকস্তরে পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের ভাল লাগেনি।
জেলায় জেলায় কাউন্সিল তৈরি হল, মিটিংও হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শাসক দলের সদস্যরা নীরব অসহযোগিতা শুরু করলেন। বিরোধী সদস্যদের সুপারিশগুলো গ্রাহ্য করা হল না, তাঁদের প্রশ্নের উত্তরও দিলেন না। এমনকী একটি সরকারি কমিটির কাজে গেলে সদস্যদের যে ধরনের সহায়তা করার কথা, তা-ও করলেন না জেলার সরকারি কর্মীরা। বিরোধীরা উৎসাহ হারালেন। জেলা কমিটির মিটিং বন্ধ হয়ে গেল। তার রিপোর্ট চেয়ে চেয়েও পেলেন না আমলারা।
অবশ্য খুব উৎসাহী যে বিরোধীরা ছিলেন, তা-ও নয়। জেলা কাউন্সিলকে সক্রিয় রাখতে, তার সুযোগ নিয়ে উন্নয়নের প্রশ্নে সরকারের উপর চাপসৃষ্টি করতে তাঁরাও আগ্রহ দেখাননি। তার আর একটি দৃষ্টান্ত আছে। কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল, প্রতিটি জেলার ‘ভিজিল্যান্স অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ তৈরি করতে হবে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকার খরচে তা নজরদারি করবে। তাদের রিপোর্ট না পেলে ফের টাকা আসবে না। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, বিরোধীরা তাঁদের কাজ করলেন না। মিটিং করাতেই আগ্রহ নেই তাঁদের। কেন্দ্রও ভিজিল্যান্স কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার শর্তে ঢিলে দিল।
গ্রাম উন্নয়ন সমিতির স্তরে আবার বিরোধীদের যোগদানের ছবিটা অন্য রকম। অনেক জায়গায় তাঁরা মারধরের ভয়ে এলেন না মিটিং-এ, অনেক জায়গায় উদাসীনতা বা অজ্ঞতার জন্য। বিশেষত মহিলা সদস্যরা বলতেন, ‘আমাকে ডাকেনি, কেন যাব,’ বা ‘গিয়ে কী হবে, আমার কথা শুনবে না।’ তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে শাসক-বিরোধী ভেদ না করে সমিতি তৈরি করা শুরু করলেন গ্রামের লোকেরা। উন্নয়নের টাকা সমিতির মাধ্যমে গ্রামের জন্য খরচ হোক, চাইছিলেন তাঁরা। এতে বিপুল অস্বস্তিতে পড়লেন সব দলের নেতারা। গ্রাম উন্নয়ন সমিতিকে তুলে দেওয়ার চাপ তৈরি হল দলের মধ্যেই।
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম খারাপ ফল করল, পঞ্চায়েত দফতর থেকে সরলেন সূর্যকান্ত। আনিসুর রহমান মন্ত্রী হয়েই গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তুলে দিলেন। জেলা পরিষদ থেকে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি, গণতান্ত্রিক প্রশাসনের কাজে বিরোধীদের যেটুকু সাংগঠনিক স্থান ছিল, তা-ও অদৃশ্য হতে শুরু করল। তৃণমূল জমানায় বিরোধীরা কার্যত ‘নেই।’
আজ ‘বিরোধী’ বললে লোকে বোঝে সেই সব লোকেদের, যাঁরা ভোট এলে হইচই করেন, ক্যামেরার সামনে গলা ফাটান, অন্য সময়ে এঁটোকাঁটা, ছিটেফোঁটা কুড়িয়ে বেড়ান। সম্প্রতি বীরভূমের এক সাংবাদিক দুঃখ করে বলছিলেন, ‘লড়াকু নেতা’ বলে পরিচিত এক বিরোধী সম্প্রতি শাসকদলের দাপুটে নেতার কাছে আত্মীয়ের চাকরির দরবার করে বলেছেন, ‘ভাই, তুমিও মণ্ডল, আমিও মণ্ডল।’ নেতায় নেতায় মাসতুতো ভাই, টের পেতে গ্রামবাসীরও সময় লাগেনি।
অতএব বিরোধী না থাকলে উন্নয়নের কাজে ঠিক কী ক্ষতি হবে, গ্রামে দাঁড়িয়ে তার উত্তর পাওয়া মুশকিল। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যাহত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক প্রার্থী না থাকলে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে বাছার সুযোগটাই থাকে না। কিন্তু রাস্তা-আলো-জল-নিকাশি তৈরির কাজে সমস্যা হবে, কিংবা প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা বা বরাদ্দ টাকা খরচে স্বচ্ছতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন দাবি জোরের সঙ্গে করা যাচ্ছে না।
সত্যি বলতে কী, পঞ্চায়েতে শাসকদলের নির্বাচিত সদস্য থেকেই বা উন্নয়নের কোন কাজটা হবে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। তৃণমূলের শাসনকালে শাসক-বিরোধী সব নির্বাচিত সদস্যই এলেবেলে হয়ে পড়ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের দায় নিয়েছেন আমলারা। জেলায় প্রশাসনিক সভাতে সভাধিপতি, সভাপতিরা উপস্থিত থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি আধিকারিকদের কাছেই হিসেব তলব করেন। জেলা পরিষদ যা করে উঠতে পারেনি, তাঁর মুখের কথায় সে কাজের দায়িত্ব পান জেলাশাসক। তিরস্কার-পুরস্কার সবই জোটে আধিকারিকদের। বাম আমলে জেলাশাসক মাসে অন্তত এক দিন জেলা পরিষদের দফতরে যেতেন সভাধিপতির সঙ্গে মিটিং করতে। এখন সভাধিপতিরা মিটিং করতে যান জেলাশাসকের দফতরে।
এটাই বাস্তব। উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, বলছে শাসক দল। তা হয়তো আছে। কিন্তু পঞ্চায়েতের দফতরে তাকে পাওয়া যাবে কি?