এঁরা হলেন বঙ্গ রাজনীতির নতুন ‘ওয়্যাগ’।
যে ধারা (মতান্তরে ব্যাধি) এতদিন কংগ্রেস বা তৃণমূলে বহমান ছিল, তা কি এবার বিজেপি-তেও ঢুকে পড়ল? সোমবার শোভন-বৈশাখী এবং তার আগে সৌমিত্র খাঁ-সুজাতা মণ্ডল সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ অন্তত তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এবং ঘটনাচক্রে, সৌমিত্র এবং শোভন— দু’জনেই বিজেপি-তে এসেছেন তৃণমূল থেকে। যা দেখেশুনে অনেকে বলতে শুরু করেছেন, ‘আমদানি-করা’ রাজনীতিকরা বিজেপি-র জন্য স্ত্রী এবং বান্ধবীদের আকারে নতুন ‘মাথাব্যথা’ বয়ে আনছেন। এঁরা হলেন বঙ্গ রাজনীতির নতুন ‘ওয়্যাগ’।
ইংল্যান্ডের ফুটবল সাংবাদিকরা আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ওয়্যাগ’। অর্থাৎ, ‘ওয়াইফ অ্যান্ড গার্লফেন্ডস’। অর্থাৎ, ইংরেজ ফুটবলারদের গ্ল্যামারাস স্ত্রী, মহিলা বন্ধু বা সঙ্গিনী। এই জীবনসঙ্গিনীরা বড় এবং ধনী ফুটবলারদের জীবনে যে পরিমাণ ‘আনুষঙ্গিক উৎপাত’ ডেকে আনতেন, তা সহ্য করতে না পেরে বিভিন্ন দলের কোচ এবং ম্যানেজাররা গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট চলাকালীন ওই সঙ্গিনীদের ‘নিষিদ্ধ’ করার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন। বস্তুত, ভাবনার চেয়েও একধাপ এগিয়ে ‘দাবি’ করেছিলেন ফুটবলারদের সঙ্গিনীদের নিষিদ্ধকরণের। যদিও শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। কারণ, ফুটবলাররা বেঁকে বসেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, স্ত্রী বা সঙ্গিনীরা সঙ্গে থাকলে তাঁদের মনঃসংযোগে সুবিধা হয়। কিন্তু ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর কাছে ‘ওয়্যাগ’-রা এক চিরকালীন ‘কাঁটা’ হয়েই রয়ে গিয়েছেন।
বেকহ্যাম দম্পতি। ফাইল চিত্র।
যে ‘কাঁটা’র ঘায়ে আপাতত ক্ষতবিক্ষত বঙ্গ বিজেপি। সোমবার রাতেই দলের এক প্রথমসারির নেতা বলছিলেন, ‘‘কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের মতো কেন্দ্রীয় স্তরের নেতাকেও শোভন-বৈশাখীর মিছিলে না-আসার ঘটনায় যে পরিমাণ বিড়ম্বনায় পড়তে হল, তা অভাবনীয়। স্মরণকালের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি। এ বার বোধহয় অন্য দল থেকে যোগদান করানোর বিষয়ে এই বিষয়টা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে।’’ ওই নেতার আরও বক্তব্য, ‘‘বাংলার নীলবাড়ি আমরা দখল করতে চাই ঠিকই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই ধরনের ঘটনায় আমরা বারবার আপস করতে থাকব। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছাপ যদি দলের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। সেটা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।’’
বঙ্গ রাজনীতি এর আগে দেখেছে বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতি সুদীপ-নয়না, দাশমুন্সি দম্পতি প্রিয়রঞ্জন-দীপা, মিত্র দম্পতি সোমেন-শিখা, বক্সি দম্পতি সঞ্জয়-স্মিতা। হালে ভুঁইয়া দম্পতি মানস-গীতা বা চৌধুরী দম্পতি অধীর-অতসী। অন্যদিকে, বাম রাজনীতিতে পুততুণ্ড সমীর-অনুরাধা, চক্রবর্তী সুভাষ-রমলাদের। শেষোক্ত দম্পতিদের উভয়েই রাজনীতির আঙিনা থেকে এসেছিলেন। রাজনীতি করতে করতেই প্রণয়। অতঃপর পরিণয়। পক্ষান্তরে, অবামপন্থী রাজনীতির কুশীলবেরা প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন রাজনীতির বাইরের জগৎ থেকে আসা প্রণয়ীদের সঙ্গে। বেশ কয়েক বছর আগে একটা সময় এমনও গিয়েছে যে, দলের শীর্ষমহলে স্ত্রী-রা অনুযোগ করেছেন, রাজনীতির কারণে স্বামী পরিবারে সময় দিতে পারছেন না। তখন আবার শীর্ষনেতা বা নেত্রী একাধারে স্বামীদের বুঝিয়েছেন, সংসারধর্মটাও পালন করতে হবে রাজনীতির ধর্মের মতোই। অন্যদিকে স্ত্রী-দের মানভঞ্জন করেছেন। দেবা এবং দেবী আবার জুড়ে গিয়েছেন কালের নিয়মে।
কিন্তু বিজেপি? এ বঙ্গে আগে এ জিনিস ঘটেনি। সোমবার শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে দিনভর বিজেপি-কে নাকানিচোবানি খাওয়ালেন বা সৌমিত্র-সুজাতা কিছুদিন আগে দিনভর যে ‘সোপ অপেরা’ সাজিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার আমজনতার জন্য, বিজেপি-তে তা বিরল। তার আগে সৌমিত্র-সুজাতার খুব কাছাকাছি ‘টিআরপি’ পেয়েছিল শোভন চট্টোপাধ্যায়-রত্না চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ত্রিকোণ’। দু’টি ‘সম্পর্ক’ নিয়েই যথেষ্ট বিড়ম্বনায় বিজেপি। যেখানে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি বা অবনতি গড়িয়ে গিয়েছে রাজনীতির আঙিনায়। যা বিজেপি-র মতো একটি দলের নেতাদের কাছে একেবারেই অনভিপ্রেত। বিশেষত, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের এই গনগনে আবহে। যেখানে রাজনৈতিক ঘটনাবলিই প্রধান হওয়া উচিত ছিল, সেখানে পাকেচক্রে তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের কুম্ভীপাকে পড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির অনবরত লাট খেতে থাকা, সম্পর্কের অবনতি, তজ্জনিত ব্যক্তিগত আক্রমণ, প্রকাশ্যে চোখের জল এবং সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কাদা ছোড়াছুড়ি।
আরও পড়ুন: অশোকনগরে বিনামূল্যে জমি দেব: মুখ্যমন্ত্রী
বস্তুত, সৌমিত্র-সুজাতার ঘটনা কোভিড-ধ্বস্ত ২০২০ সালে জনতাকে সবচেয়ে বেশি চমকিত করেছে। যেখানে স্ত্রী অন্য একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ায় স্বামী সাংবাদিক বৈঠক ডেকে প্রকাশ্যে স্ত্রী-কে বিবাহবিচ্ছেদ করছেন! সে অর্থে বলতে গেলে চলে-যাওয়া বছরে ওই ঘটনাটিই সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ। এমন ঘটনা সাম্প্রতিক কেন, দূর অতীতে জাতীয় রাজনীতিতে ঘটেছে বলেও কেউ মনে করতে পারছেন না। বঙ্গ রাজনীতি তো দূরস্থান! বিজেপি ওই ‘ব্যক্তিগত’ ঘটনাপ্রবাহ থেকে সন্তর্পণে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু সুজাতা যে ভাবে আবার প্রকাশ্যে সৌমিত্রকে বিবাহবিচ্ছেদ দেবেন না বলে ঘোষণা করে বসেছেন, তাতে এই ঘটনার জল বিধানসভা ভোটের আগে রাজনীতিতে গড়িয়ে আসাই স্বাভাবিক। তেমন হলে বিজেপি কি দলীয় সাংসদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিজেদের ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রাখতে পারবে? দলের একাংশ কিন্তু তা মনে করছেন না।