ইন্টারনেটে ভিডিওটা দেখে হেসে কুটোপাটি সকলে। লাল বলটা নিয়ে কী খেলা বিড়ালটার!
কখনও আবার একরত্তি শিশুর দামালপনা দেখে চোখ কপালেই উঠে যায়। তড়িঘড়ি ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে সেটাকে ফেসবুকে আপলোড করতেও দেরি করেন না অনেকে!
আমজনতার অভিজ্ঞতা বলছে, নিত্যদিনই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট কিংবা ই-মেলে এমন হাজারো ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে। হোয়াটস অ্যাপ মারফত ভিডিও আসছে মোবাইল ফোনেও। এক জনের কাছ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে হাজারো লোকের কাছে। যদিও এই সব ভিডিওর পিছনে অপরাধের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এই ভিডিও দেখার আড়ালেই সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে পারেন কেউ, চুরি হয়ে যেতে পারে ব্যক্তিগত তথ্যও!
কী ভাবে?
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সব ভিডিওর অনেকগুলিই হ্যাকারদের তৈরি করা। ভিডিওর ভিতরেই ভাইরাস প্রোগ্রামিং করে তা ছেড়ে দেওয়া হয় ইন্টারনেটে। ভিডিও দেখার সময় ব্যবহারকারীর অজান্তেই ভাইরাস সিঁধিয়ে যায় কম্পিউটার
বা ফোনে। ওৎ পেতে বসে থাকে সেখানে। তার পর ওই ভাইরাসই ব্যবহারকারীর গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে দিতে থাকে বহু দূরে বসে থাকা হ্যাকারের হাতে। সম্প্রতি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাবের একদল সাইবার-বিশেষজ্ঞ এই তথ্য প্রকাশ করেছেন ‘ডিজিটাল হিউম্যান রাইটস’-এর রিপোর্টে।
বছর খানেক আগে এমন ঘটনার কথা জানতে পেরেছিল লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগও। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “অচেনা একটি লোকের কাছ থেকে এমনই একটি মজার ই-মেল পেয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী। তিনি ভিডিওটি খুলতেই ভাইরাস ঢুকে পড়েছিল কম্পিউটারে। এর কিছু দিন পরেই ওই ব্যবসায়ী জানতে পারেন, বিদেশের এক গ্রাহকের কাছ থেকে তাঁর প্রাপ্য অর্থ চলে গিয়েছে অন্য এক জনের অ্যাকাউন্টে। খোঁজ নিয়ে জানেন, তাঁর মেল থেকেই অন্য একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়ে চিঠি গিয়েছিল ওই গ্রাহকের কাছে। সেখানেই টাকা গিয়েছে।” তদন্তে নেমে পুদুচেরি থেকে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে লালবাজার।
কিন্তু কেন এই পথ বেছে নিচ্ছে হ্যাকারেরা?
সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরনো পদ্ধতি সম্পর্কে লোকজন সতর্ক হয়ে গিয়েছে। তাই লটারির টোপ কিংবা সস্তায় জিনিস কেনার টোপ দিয়ে ফাঁদে ফেলার সম্ভাবনা খুবই কম। উল্টো দিকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার
ফলে নানা ধরনের মজার ভিডিও ডাউনলোড করা ও একে অন্যকে পাঠানোর সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে। তাই সহজে শিকার ধরতে এই সব মজার ভিডিওকেই হাতিয়ার করছে সাইবার অপরাধীরা।
তা ছাড়া এত দিন হ্যাকিং করা হলেই কিছু না কিছু গণ্ডগোল টের পেতেন ব্যবহারকারী। কখনও ই-মেলের সব তথ্য উড়ে যেত, কখনও বা অকেজো হয়ে পড়তো যন্ত্রটি। মার্কিন সাইবার-বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন এ ক্ষেত্রে ভাইরাস কম্পিউটারে ঢুকে বসে থাকলেও আক্রান্তরা টেরই পান না। নজরদারি চলতে থাকে।
সাইবার-বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “হ্যাকারদের এমন একটা পথ বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ফ্রি অ্যাপস ডাউনলোড করার প্রবণতা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। কোনও গেম-ই হোক বা ভিডিও, যা কিছু বিনামূল্যে মিলছে, তা-ই ডাউনলোড করে ফেলছেন সকলে। আর ঠিক সেই সুযোগটাই নিচ্ছে হ্যাকাররা।”
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দারাও এই পথ বেছে নিচ্ছেন। ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা, এনএসএ অনেকটা এ ভাবেই সাধারণ মানুষের কম্পিউটারের উপরে নজরদারি চালিয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ম্যান ইন দ্য মিডল অ্যাটাক’। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ও ব্যবহারকারীর মাঝে বসে নিয়ন্ত্রণ করছে কোনও তৃতীয় ব্যক্তি।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এই ধরনের ঘটনাকে বলা হয় ‘নেটওয়ার্ক ইঞ্জেকশন’। অর্থাৎ যে ভাবে ইঞ্জেকশন ফুটিয়ে শরীরে কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সে ভাবেই এখানে কম্পিউটার বা ফোনে ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। “সাধারণত ইঞ্জেকশন ফোটালে শরীরে ব্যথা লাগে। কিন্তু সাইবার ইঞ্জেকশনে কিছু মালুম হয় না। সাধারণ চোখে কম্পিউটারে কোনও বদলও ধরা পড়ে না।”মন্তব্য এক সাইবার বিশেষজ্ঞের।
তা হলে এই ইঞ্জেকশন থেকে বাঁচার উপায় কী?
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে অহেতুক ভিডিও শেয়ার করবেন না। দেখারও প্রয়োজন নেই। বিশেষত সন্দেহজনক কোনও ব্যক্তি বা গ্রুপ থেকে পোস্ট করা হলে তো একেবারেই নয়।
অচেনা ই-মেল খোলার আগে সতর্কতা জরুরি। স্মার্টফোন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিনামূল্যে অ্যাপস পেলেই ডাউনলোড করবেন না।
গোয়েন্দারা বলছেন, সতর্কতা ছাড়া এই হামলাকে সামলানোর মতো হাতিয়ার এই মুহূর্তে নেই। তবে তথ্য চুরি বা জালিয়াতির মতো অভিযোগ মিললে তদন্ত করা হয়। সে ক্ষেত্রে অপরাধী ধরা পড়লে শাস্তি মিলতে পারে। “কিন্তু তার আগে অহেতুক ফ্রি-র ফাঁদে পা না দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।” বলছেন এক গোয়েন্দাকর্তা।