উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঝুঁকির কাজে নামতে হচ্ছে ঠিকা শ্রমিকদের। ফলে, ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক কারখানায় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাও এই ধরনের দুর্ঘটনার কারণ, দুর্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে স্বীকার করলেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। তিনি বলেন, “ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই ঠিকা শ্রমিক। মূলত তাঁদেরই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ঠিক মতো জ্ঞান না থাকায় তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হন। গত তিন বছরে দুর্ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, এখনও বহু কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ নয়।”
দুর্গাপুর ও লাগোয়া এলাকায় শ’খানেকেরও বেশি বেসরকারি স্পঞ্জ আয়রন, ফেরো অ্যালয়, পিগ আয়রন, রোলিং মিলস কারখানা রয়েছে। সেগুলিতে মাঝে-মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উচ্চ তাপমাত্রায় গলিত লোহার মতো জিনিস নিয়ে ঠিকা শ্রমিকেরা কাজ করেন। গলিত লোহা ছিটকে বা বয়লার ফেটে গত কয়েক বছরে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। দেখা গিয়েছে, মৃত বা জখম ঠিকা শ্রমিকদের মাথায় হেলমেট বা পায়ে উপযুক্ত জুতো ছিল না। আসানসোল শিল্পাঞ্চলে একাধিক রিফ্যাক্টরি শিল্প আছে যেখানে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি একেবারেই নজরে রাখা হয় না বলে অভিযোগ। একই পরিস্থিতি সিমেন্ট শিল্প ও স্পঞ্জ আয়রন কারখানাতেও।
দুর্ঘটনা ছাড়া রয়েছে দূষণের অভিযোগ। স্পঞ্জ আয়রন কারখানার বিরুদ্ধে দূষণ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে স্থানীয় বাসিন্দারা বহু বার বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এলাকায় বহু ইট কারখানাও রয়েছে। সেগুলিতে মাটি ও কয়লার জ্বালানির দূষণে জেরবার হন শ্রমিক-কর্মীরা। কল্যাণেশ্বরী শিল্পতালুকের একাধিক শিল্প কারখানাতেও মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে।
শ্রম দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৮ সালে দুর্গাপুরের আঞ্চলিক শ্রম দফতরের এক রিপোর্টে বলা হয়, কারখানাগুলিতে অধিকাংশ শ্রমিক ন্যূনতম বেতন পান না। কর্মরত অবস্থায় জখম হলে ক্ষতিপূরণও মেলে না। এ ছাড়া শ্রমিকদের পরিচয়পত্র, শ্রমিককল্যাণ ও শ্রমিক-স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনও পরিকাঠামো নেই। বিপজ্জনক যন্ত্রাংশে রেলিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়নি। উপযুক্ত সুরক্ষার সরঞ্জাম ছাড়াই দূষণের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হন শ্রমিকেরা। কারখানায় কত জন অদক্ষ শ্রমিক কাজ করেন তার স্পষ্ট হিসেবও দিতে পারেননি বেশ কিছু কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের বক্তব্য, রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরেও পরিস্থিতি খুব বেশি উন্নতি হয়নি। আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “আগে দুর্ঘটনা ঘটলে সিটুর সঙ্গে মালিকপক্ষের বোঝাপড়ায় বঞ্চিত হত ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকা শ্রমিকের পরিবার। কিন্তু আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ঠিকা শ্রমিকের পরিবারকে ৯ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, কাজের নিরাপদ পরিবেশ ও বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে লাগাতার আন্দোলনও চলছে।”
দুর্গাপুরের সিটু নেতা তথা প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “শ্রমিক স্বার্থে সিটু বরাবর আন্দোলন করেছে। আন্দোলন হয়েছে শ্রম দফতর, পরিবেশ দফতরের বিরুদ্ধেও।” আসানসোলের সিটু নেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “এই সব কারখানা মালিকেরা নিজেদের মুনাফাই দেখেন। মলিকেরা শ্রমিকদের ইএসআই-এর টাকাও জমা দেন না। ফলে, দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁরা উপযুক্ত চিকিৎসাও পান না।’’ একই দাবি আইএনটিইউসি নেতা চণ্ডী চট্টোপাধ্যায়েরও। তাঁর বক্তব্য, “রিফ্যাক্টরি শিল্পে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও ঠিক মতো জমা দেওয়া হয় না। ফলে, চাকরি ছাড়ার পরে শ্রমিক-কর্মীরা শেষ সম্বলটুকুও পান না।’’ শ্রম দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৩ সালে রাজ্যে ৯৬ জন নানা কল-কারখানায় দুর্ঘটনার শিকার হন। এ বছর প্রথম ৬ মাসে সেই সংখ্যা মাত্র ১২। শ্রমমন্ত্রী বলেন, “পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটা ভাল হয়েছে। উন্নতির আরও অবকাশ রয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলির সঙ্গে লাগাতার যোগাযোগ রাখা হয়েছে।”
এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে (ডিএসপি) কাজের জায়গায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন পূর্ণেন্দুবাবু। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ অকুপেশন্যাল হেলথ (পশ্চিমবঙ্গ) আয়োজিত শনিবারের ওই অনুষ্ঠানে রাজ্যের ‘ডাইরেক্টরেট অফ ফ্যাক্টরিজ’ বরুণ শিকদার বলেন, “ডিএসপি বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ করেছে। প্ল্যান্ট মেডিক্যাল সেন্টারে অক্সিজেন চেম্বারের সংখ্যা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। ফলে, হঠাৎ বিপজ্জনক গ্যাস লিক হয়ে কেউ আক্রান্ত হলে দ্রুত অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হবে।”