শিল্প ও বাণিজ্য মেলার প্রস্তুতি বার্নপুরে।
নতুন শিল্পের দেখা নেই। উল্টে একের পর এক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু চলছে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে। কাজ হারিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এই শিল্পাঞ্চলের এমন বিবর্ণ ছবি বদলাতে বর্তমান রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়নি বলে বেশ কিছু দিন ধরেই অভিযোগ তুলে আসছে আসানসোল-দুর্গাপুরের নানা শ্রমিক সংগঠন। এই পরিস্থিতিতে কাল, বৃহস্পতিবার বার্নপুরে শিল্প ও বাণিজ্যমেলায় আসার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
দিন কয়েক আগে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র আসানসোলে এসে দাবি করে গিয়েছেন, সারা দেশের তুলনায় এ রাজ্য বৃদ্ধিতে এগিয়ে রয়েছে। মন্ত্রী এমন দাবি করলেও বর্ধমান জেলার চিত্রটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১০৪টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বেসরকারি ইস্পাত কারখানা ছিল। তার মধ্যে ৩১টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও। কাজ হারিয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক।
সিটু, বিএমএস, টিইউসিসি, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, ইউটিইউসি-সহ আরও বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন সম্প্রতি দুর্গাপুরের মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেয়। শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, গত তিন বছরে রাজ্যে প্রায় ১৭টি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাদের আরও অভিযোগ, রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দেড়-দুই দশক ধরে কাজ করে আসা প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঠিকা শ্রমিককে ডিএসপি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই জায়গায় রাজ্যের শাসকদলের শ্রমিক সংগঠন নিজেদের লোক ঢুকিয়েছে। সিটুর অভিযোগ, সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী নিজে ডিএসপি কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে গিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যপালেরও কাছেও গিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায়নি বলে অভিযোগ সিটুর জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্রকিশোর চক্রবর্তীর।
দুর্গাপুরের বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা রাস্ট্রায়ত্ত সংস্থা মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশন (এমএএমসি) খোলার উদ্যোগ শুরু হয় ২০০৭ সালে। ২০১০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে নিলামে একশো কোটি টাকা দর দিয়ে কারখানাটি নিয়ে নতুন করে খোলায় উদ্যোগী হয় তিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেড (বিইএমএল), কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড (সিআইএল) এবং দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি)-এর কনসোর্টিয়াম। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ছাড়পত্র না মেলায় এগোতে পারেনি সেটির অধীনস্ত সংস্থা বিইএমএল। শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, আগের আমলে তবু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক বার চিঠি দিয়ে দ্রুত কারখানা খোলার আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকার আদৌ বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়নি। একই ভাবে দুর্গাপুরের বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা এইচএফসিএল-কেও বিআইএফআর-এর আওতা থেকে বের করার ব্যাপারে বর্তমান রাজ্য সরকার সচেষ্ট হয়নি বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের।
শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শিল্পাঞ্চলে সিন্ডিকেট চালানো, নানা সংস্থায় তোলাবাজি, হামলা, ভাঙচুর, দৌরাত্ম্যের অভিযোগ বারবার উঠেছে এই জেলায়। অনেক ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ করার নোটিস ঝোলাতে বাধ্য হয়েছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। হামলার হাত থেকে বাদ যাননি তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার কর্মীরা। শাসকদলের সমর্থকদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেও নাজেহাল হতে হয়েছে নানা সংস্থাকে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পাঞ্চলে এলেও কখনও এ সবের বিরুদ্ধে সরব হননি বলে অভিযোগ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না হওয়ায় আতঙ্ক রয়েই গিয়েছে বলে দাবি বহু ব্যবসায়ীর। কখনও-সখনও দল থেকে বহিষ্কারের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে অনেক বহিষ্কৃৃত নেতাকেই বহাল তবিয়তেই দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখা গিয়েছে।
সম্প্রতি রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে জেলা সফরের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বার্নপুরে তাঁর শিল্পমেলার উদ্বোধন করার কথা। সিটুর জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্রকিশোরবাবু অভিযোগ করেন, “গত তিন বছরে শিল্পাঞ্চল কার্যত শ্মশান হয়ে গিয়েছে। শিল্পের পরিবেশ নেই গোটা জেলায়। সর্বত্র তোলাবাজি আর সিন্ডিকেটের দাপটে নাজেহাল দশা। এখন আর কী করার আছে?” আইএনটিইউসি নেতা উমাপদ দাসেরও দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীর এই সফরে পরিস্থিতি বদলাবে বলে মনে হয় না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।” শাসকদলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “বাম আমলে শিল্পের সর্বনাশ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আসন্ন সফরের মাধ্যমে শিল্প সংক্রান্ত সমস্যাগুলি প্রশাসনের শীর্ষস্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নতুন করে শিল্পের জোয়ার আসবে জেলায়।”