মেঠো হোলিতে মাততে তৈরি গ্রাম

পুজো দেওয়ার জন্য রাত পর্যন্ত মহিলাদের লম্বা লাইন, ধারালো ফলার নীচে শুয়ে থাকা দেবদেবীর আদলে সেজে ওঠা সন্ন্যাসী ব্রত নেওয়া মানুষ--চড়ক উত্‌সবে মেতে ওঠার আগে রবিবার, নীলপুজোর দিনে ও রাতে কালনার কৃষ্ণদেবপুরের ‘মুড’ ছিল এ রকমই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কালনা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৬
Share:

চড়কের আগের প্রস্তুতি। কৃষ্ণদেবপুরে মধুমিতা মজুমদারের তোলা ছবি।

পুজো দেওয়ার জন্য রাত পর্যন্ত মহিলাদের লম্বা লাইন, ধারালো ফলার নীচে শুয়ে থাকা দেবদেবীর আদলে সেজে ওঠা সন্ন্যাসী ব্রত নেওয়া মানুষ--চড়ক উত্‌সবে মেতে ওঠার আগে রবিবার, নীলপুজোর দিনে ও রাতে কালনার কৃষ্ণদেবপুরের ‘মুড’ ছিল এ রকমই।

Advertisement

গোটা জেলার মধ্যে যে জায়গাগুলিতে চড়ক-গাজন উত্‌সব ধুমধাম করে পালিত হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল কৃষ্ণদেবপুর। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ষাট বছর আগে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ থেকে অনেক বাসিন্দা এসে কৃষ্ণদেবপুরের রাজবংশীপাড়ায় বসবাস করতে শুরু করেন। পেশায় মত্‌স্যজীবী ওই পরিবারগুলিই শুরু করেন গাজন উত্‌সব। প্রতি বছরই এই উত্‌সব উপলক্ষে এলাকার কয়েকশো মানুষ সন্ন্যাসী ব্রত পালন করেন। কেই চৈত্র মাসের শুরু থেকে, আবার কেউ চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে ব্রত পালন শুরু করেন। ব্রত পালকদের মধ্যে অনেক কিশোরও থাকেন। রেওয়াজ অনুযায়ী চড়ক উত্‌সবের সপ্তাহ খানেক আগে বিশেষ তিথি অনুযায়ী গ্রামের মহাদেব মন্দিরের অন্যতম বিগ্রহ পাট ঠাকুরকে ঢাক, ঢোল, সানাই-সহযোগে গঙ্গা স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাট ঠাকুরের সঙ্গেই ব্রতধারী সন্ন্যাসীরাও গঙ্গাস্নান করেন। পাট ঠাকুরকে গঙ্গাস্নানের পরে মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। তারপর নীলপুজোর আগের দিন পর্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পুজিত হন পাট ঠাকুর।

নীলপুজোর আগের রাতে স্থানীয় বাসিন্দারা নানা রূপে সেজে ওঠেন। হয় নাচগান। উত্‌সবের জৌলুস বাড়ে নীলপুজোর দিন। রবিবার নীলপুজোর সকাল থেকেই কৃষ্ণদেবপুর, ধাত্রীগ্রাম, হাটকালনা থেকে মহিলারা কৃষ্ণদেবপুরের মহাদেব মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন। রাত ৮টাতেও মন্দির চত্বরে দেখা গিয়েছে মহিলাদের দীর্ঘ লাইন। এ দিন রাত ১১টার পরে ব্রতচারী সন্ন্যাসীদের নিয়ে শুরু হয় নানা অনুষ্ঠান। সেখানে কেউ সাজেন দুর্গা, কেউ বা কালী, আবার কেউ অন্য কোনও দেবতা। সারা রাত ধরেই চলে বিভিন্ন খেলা। সেখানে কেউ আশ্চর্য দক্ষতায় হেঁটে যান অনেকগুলি রাম দার উপর দিয়ে, কেউ শুয়ে থাকেন তীরের ফলার উপর। এ দিন মহাদেব মন্দির চত্বরে গিয়েছিলেন, কালনা উত্তরের বিধায়ক বিশ্বজিত্‌ কুণ্ডু। তিনি বলেন, “এই এলাকার চড়ক উত্‌সব বহু পুরনো। উত্‌সবকে ঘিরে এত বৈচিত্র্য না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

Advertisement

নীল পুজোর শেষ রাতে হয় কালীচালান অনুষ্ঠান। রীতি অনুযায়ী, মন্দির সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি কলাগাছ দিয়ে তৈরি করা হয় কৃত্রিম শ্মশান। রাম দা নিয়ে সেখানে গিয়ে ব্রত নেওয়া এক জন সন্ন্যাসী শ্মশান কালীর পুজো করেন। তার পর কলাগাছগুলিকে কেটে নাচতে নাচতে তিনি ফিরে আসেন মহাদেবের মন্দিরে।

আজ, সোমবার গ্রামে হবে চড়ক উত্‌সব। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গ্রামের মন্দিরের পাশের একটি পুকুরে চড়কের শালদণ্ড রাখা থাকে। প্রায় ৩৫ ফুট লম্বা এই শালদণ্ডটিকে চড়কের বিকেলে জল থেকে তুলে পুজো করা হয়। তার পরে কৃষ্ণদেবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে পোঁতা হয় শালদণ্ডটিকে।

স্থানীয় বাসিন্দা বিষ্ণু রাজবংশী, নিমার্ল্য সরকাররা জানান, চড়কের পরের দিন, সন্ন্যাসীরা মেঠো হোলিতে মেতে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে চলে মাটি মাখামাখি। বিকেলে গ্রামে বসে মত্‌স্যমুখী অনুষ্ঠান। পাত পেড়ে খাওয়ানো হয় ভাত ও মাছ। কৃষ্ণদেবপুর চড়ক পুজো কমিটির সম্পাদক প্রদীপ রাজবংশী বলেন, “চড়কের ঐতিহ্য অনুয়ায়ী, গত বছর ৩০ জন সন্ন্যাসী পিঠে বঁড়শির একপ্রান্ত ফুটিয়ে বঁড়শির অন্য প্রান্ত শালদন্ডটিকে আটকে নিয়ে ঘুরেছিল। সেই সঙ্গে প্রায় ২৫০ জন সন্ন্যাসী নিজেদের জিভে লোহার শিক ফুটিয়েছিলেন। এ বার সেই সংখ্যাটা আরও বাড়বে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement