বৈষ্ণব সাধকের স্মৃতিতে আজও মজে উদ্ধারণপুর

এক বৈষ্ণব সাধকের তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে মুর্শিদাবাদের সোনারুন্দী রাজাদের হাত ধরে যে মেলা শুরু হয়েছিল, দেড়শো বছর পরেও জমজমাট সেই মেলা। ফি বছর মকর সংক্রান্তির সময়ে কাটোয়া শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী পাড়ের উদ্ধারণপুরে এই মেলা বসে। রাজবাড়ির তত্ত্বাবধানেই হয় মেলাটি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কাটোয়া শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:২৬
Share:

মেলায় চলছে অনুষ্ঠান। —নিজস্ব চিত্র।

এক বৈষ্ণব সাধকের তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে মুর্শিদাবাদের সোনারুন্দী রাজাদের হাত ধরে যে মেলা শুরু হয়েছিল, দেড়শো বছর পরেও জমজমাট সেই মেলা। ফি বছর মকর সংক্রান্তির সময়ে কাটোয়া শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী পাড়ের উদ্ধারণপুরে এই মেলা বসে। রাজবাড়ির তত্ত্বাবধানেই হয় মেলাটি।

Advertisement

বহু দিন ধরেই উদ্ধারণপুরের শ্মশানঘাট রাঢ়বঙ্গে বিশেষ পরিচিত। এই শ্মশান ঘাট নিয়েই অবধূত ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেই শ্মশানঘাট থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে চার একর জমির উপর এই মেলা বসে। কথিত আছে, নৈহাটির নৈরাজা নামে এক রাজার দেওয়ান ছিলেন উদ্ধারণ দত্ত। পরে হুগলির সপ্তগ্রামের এই বাসিন্দা সমস্ত ঐশ্বর্য ছেড়ে শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ নিত্যানন্দের সঙ্গী হন। নিত্যানন্দের নির্দেশ মতোই কাটোয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভাগীরথী তীরে এক জায়গায় আশ্রম গড়ে তোলেন তিনি। সেখান থেকেই শ্রীচৈতন্যের ভাবধারা প্রচার করতে শুরু করেন তিনি। অবধূতের উপন্যাসে পাওয়া যায়, উদ্ধারণ দত্তের নামানুসারে ওই জায়গার নাম হয় উদ্ধারণপুর। এক সময় মুর্শিদাবাদের সালার থানার বনওয়ারিবাদ (সোনারুন্দী রাজবাড়ি বলেই বেশি পরিচিত) রাজ পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছিল উদ্ধারণপুর। রাজ পরিবারের সদস্যেরা গঙ্গাবাস করতে আসতেন এখানে। তখন থেকেই মকর ও উত্তর সংক্রান্তিতে মুর্শিদাবাদ,বীরভূম ও বর্ধমানের একটা বড় অংশের মানুষের উদ্ধারণপুরের গঙ্গায় স্নান করতে আসার রেওয়াজ শুরু হয়।

গবেষকেরা জানান, বনওয়ারিবাদ রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নিত্যানন্দের বড় পুত্র জগদীন্দ্র বনওয়ারিলাল বাহাদুরের সময়ে এই মেলা শুরু হয়। উদ্ধারণপুরে রাজপরিবার মন্দির তৈরি করে গৌর, নিতাই ও বলরামের দারুমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। কথিত আছে, নিঃসন্তান উদ্ধারণ দত্ত তাঁর মৃত্যুর পরে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম কে করবে এই নিয়ে খুব চিন্তিত থাকতেন। একদিন স্বপ্নে দেখেন, বলরাম তাঁর ছেলে হয়ে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করছেন। পরে ৯৪৮ বঙ্গাব্দে ৬০ বছর বয়সে মারা যান উদ্ধারণ দত্ত। কথিত আছে, ওই মন্দির থেকে বের হয়ে বলরাম উদ্ধারণ দত্তের সমাধিতে গিয়ে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সারেন। সেই রেওয়াজ চলে আসছে এতদিন। তবে এখন সারা বছর উদ্ধারণপুরে বিগ্রহগুলি থাকে না। রাজ পরিবারের ভিতরে মন্দিরে থাকে সেগুলি। সোনারুন্দী থেকে ১৫ জানুয়ারি পালকি করে ওই তিনটে বিগ্রহ ৮ কিলোমিটার দূরের উদ্ধারণপুরে আনা হয়। গবেষকরা জানান, রাজ পরিবারের মন্দিরের ভগ্ন দশা হওয়ার পর থেকেই বিগ্রহগুলিকে সোনারুন্দী নিয়ে চলে যান উত্তরসূরীরা। তারপর থেকে এই ব্যবস্থা। রাজ পরিবারের প্রতিনিধি অনন্ত ঘোষ বলেন, “উদ্ধারণপুরে ছ’দিন থাকে বিগ্রহগুলি। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির দিন উদ্ধারণ দত্তের তিরোধান দিবস পালন করা হয়। তার পরের দিন অন্নভোগ উপলক্ষে প্রচুর মানুষের ভিড় হয়।” প্রতি বছরই কেতুগ্রাম, কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার বাসিন্দারা মেলায় ভিড় জমান। চালডাল নিয়ে এসে মেলার মাঠে কিংবা ভাগীরথীর পাড়ে খিচুড়ি রান্না করে পাত পেড়ে খাওয়া দাওয়া করেন অনেকে। কেতুগ্রামের কান্দরার বাসিন্দা আশিস ঠাকুর বলেন, “গরুর গাড়িতে করে আমরা দল বেধে উদ্ধারণপুরে যেতাম। উত্তর সংক্রান্তিতে গঙ্গায় স্নান করে, মেলার মাঠে থেকে বাড়ি ফিরতাম। তখন মেলার চেহারা এত বড় ছিল না। এখন মেলা অনেক বড় হয়েছে।” আর পাঁচটা গ্রামীণ মেলার মতো এই মেলাতেও নাগরদোলা, পাঁপড় ভাজা থেকে হরেক জিনিসের দোকান বসেছে। নৌকা করে শীতের মিঠে রোদ মাখতে মাখতে মেলায় যাওয়ার আনন্দও রয়েছে। তবে সঙ্গে রয়েছে পানীয় জল, শৌচাগারের সমস্যা। স্থানীয় সিতাহাটি গ্রাম পঞ্চায়েত সূত্রে জানানো হয়েছে, এ বছর তাঁরা বেশ কয়েকটি নলকূপ বসিয়েছেন মেলা চত্বরে। তবে শৌচাগারের সমস্যা এখনও রয়ে গিয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement