পূর্বস্থলীতে ভাগীরথীর পাড়ে খোলা জায়গাতেই চলছে কঙ্কাল তৈরি। —নিজস্ব চিত্র।
বেশ কয়েকবার গোপন ডেরায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তদন্তে নেমেছে সিআইডিও। তারপরেও ভাগীরথীর পাড়ে দেদারে চলছে কঙ্কাল তৈরির ব্যবসা। বর্ধমানের পূর্বস্থলী তো বটেই লাগোয়া জেলাগুলিতেও এই কারবার দীর্ঘদিন চলছে বলে জানা গিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় তিন দশক আগে মুক্তি বিশ্বাস নামে এক ব্যবসায়ী বেলের হল্ট স্টেশন লাগোয়া যজ্ঞেশ্বরপুর ঘাটে ওই কারবার শুরু করেন। ২০০৮ সালে তার কারখানা থেকে প্রচুর কঙ্কাল উদ্ধার হয়। ঘটনার তদন্তে নামে সিআইডি। তবে বেশ কয়েকবার অভিযান চালানো সত্ত্বেও কারখানা বন্ধ হয়নি। বরং লাভজনক হওয়ায় আরও বড় এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসা। দেবনগর চর, মেড়তলা চর, কাটোয়ার কালিকাপুর এলাকা ছাড়াও নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের নানা ঘাটেও দেদার চলছে এই ব্যবসা। পরবর্তীতে কয়েকজন সাগরেদকে তালিমও দেন মুক্তি বিশ্বাস। এখন বয়স হওয়ায় কারবার থেকে নিজে সরে গেলেও তার সাগরেদরা ভাগীরথীর পূর্বস্থলী, কাটোয়া, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ লাগোয়া বিভিন্ন ঘাটে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বছর খানেক আগে পূর্বস্থলী ২ ব্লকের দেবনগর চর এলাকায় একটি কঙ্কাল তৈরির কারখানায় হানা দিয়ে মনোজ পাল ওরফে গপসা নামে এক যুবককে ধরে পুলিশ। তার কাছ থেকে বেশ কয়েক বস্তা মড়ার খুলি, হাড়গোড় ও কঙ্কাল উদ্ধারও হয়। তবে কয়েকদিন জেল খাটার পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় গপসা। ডেরা বদলে আবারও শুরু করে একই ব্যবসা। একাধিকবার জেল খাটতে হয়েছে মুক্তি বিশ্বাসকেও।
কঙ্কাল ব্যবসায়ীদের দাবি, রাজ্য এমনকী দেশের বাইরেও সবচেয়ে বেশি কঙ্কাল পাচার হয় পূর্বস্থলী থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, সারা বছর অজস্র বার ডেরা পাল্টায় ব্যবসায়ীরা। কখনও পুলিশের ভয়ে, কখনও দূষণের জেরে গ্রামবাসীরা রুখে দাঁড়ালে পাততাড়ি গোটাতে হয় তাদের। পূর্বস্থলীর মেড়তলা এলাকার বাসিন্দা রাখাল সর্দারের কথায়, “কারবারিদের পুলিশ ধরলেও কয়েকদিনের মধ্যেই তারা ছাড়া পেয়ে যায়। ফিরে এসে নতুন জায়গায় ফের কারবার শুরু করে।”
পুলিশ এর আগেও একাধিকবার ওই কারবারিদের ধরেছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই ছাড়া পেয়ে যায় তারা। কেন? আইনজীবীরা জানান, কঙ্কাল পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইন না থাকায় তাদের তেমন শাস্তি দেওয়া যায় না। কালনা মহকুমা আদালতের এক আইনজীবী গৌতম গোস্বামী জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ বেওয়ারিশ মৃতদেহ চুরি ও আটকে রাখার মামলা দায়ের করে। কিন্তু প্রথমত, আদালতে কেউ বেওয়ারিশ দেহ দাবি করে না। দ্বিতীয়ত, ৩৭৮ ধারায় কোন কোন জিনিস চুরির মধ্যে পড়ে তার ব্যাখ্যা রয়েছে। ওই তালিকায় কঙ্কালের উল্লেখ নেই। ফলে কারবারিরা সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। কারবারিদের সহজে ছাড়া পাওয়ার কথা স্বীকার করছে পুলিশও। মহকুমা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “পেশাটি যে বিপজ্জনক তা আমরাও বুঝি। তবে সুস্পষ্ট আইন না থাকায় আমরাও বিপাকে পড়েছি। কারবার ঠেকাতে একটাই রাস্তা আছে আমাদের, তা হল ধারাবাহিক অভিযান। সেটাই চালাচ্ছি।”
কিন্তু এত দেহ মেলে কীভাবে? কঙ্কাল কারবারিরাই জানান, দু’দশক আগে অবদিও দেহ মেলার মূল ভরসা ছিল ভাগীরথী। সর্পদষ্ট হলে বা আরও নানা কুসংস্কার বশত অনেকেই দেহ ভাসিয়ে দিতেন নদীতে। ভেলায় ভাসতে থাকা দেহ আটকানোর জন্য ভাগীরথীর ঘাটে ফেলে রাখা হত লম্বা বাঁশ। তাতেই আটকে যেত দেহগুলি। পরবর্তীতে কারবারির সংখ্যা বাড়ে, কমে যায় জলে ভাসা দেহের সংখ্যা। কঙ্কাল কারবারিদেরই একাংশের দাবি, এরপরেই পথ বদলান ব্যবসায়ীরা। দেহ পাওয়ার জন্য গ্রামেগঞ্জে এজেন্ট নিয়োগ শুরু করেন তারা। ওই এজেন্টরা মর্গের বেওয়ারিশ লাশ অথবা কবর দেওয়া দেহ তুলে কারবারীদের বিক্রি করতে থাকে।
দেহ মেলার পরে তা পচানোর জন্য কারবারীরা প্রথমে ডেরার আশপাশে গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহে দ্রুত পচনশীল রাসায়নিক লাগিয়ে পুঁতে রাখে। কিছু দিন পরে দেহটি তুলে লম্বা ড্রামে রাখা হয়। পরে বিশেষ উপায়ে মাংস ছাড়িয়ে হাড় আলাদা করা হয়। পচা মাংসের দুর্গন্ধ যাতে না বেরোয় সে জন্য প্রতি এলাকাতেই হিংস্র কুকুর রয়েছে। তারাই সাবড়ে দেয় সেই মাংস। হাড়গুলিও আলাদা ভাবে বাক্সবন্দি করে রাখা হয়।
কঙ্কাল কেনার জন্য কারিবারিদের ডেরাতেই গোপনে হাজির হয় খরিদ্দারেরা। তাদের মারফত রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও জলঙ্গি, পদ্মা পেরিয়ে বা হাওড়া-কাটোয়া শাখার বিভিন্ন লোকাল ট্রেনে বাক্সবন্দি কঙ্কাল পাচার হয়। কারবারিদের দাবি, পূর্বস্থলী থেকে কঙ্কাল যায় বাংলাদেশেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্বস্থলীর এক কারবারি বলেন, “৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় একএকটা দেহ কেনা হয়। কারখানার কর্মীদের আরও পাঁচ থেকে সাতশো টাকা দিতে হয়। তারপরে তা বিক্রি হয়ে যায় সাত থেকে দশ হাজার টাকায়।” স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ডেরার চারপাশে নজরদারি চালাতে লোকজনও মজুত রাখে কারবারিরা। নজরদার জলের ছোট ছোট নৌকা বিভিন্ন ঘাটে বাঁধা থাকে। মাছ ধরার নাম করে জলপথে নজর রাখে তারা।