সন্ত্রাসের মুখে পড়ে প্রার্থী তুলে নিতে না হলে দল ভাল ফল করত, পুরভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে উচ্চ নেতৃত্বের কাছে দাবি করেছিলেন বর্ধমান শহরের সিপিএম নেতারা। সে নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। তার পরে প্রায় সাত মাস পার। কড়া নাড়ছে আবার একটি ভোট। পুরভোটে প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত ছিল, লোকসভা ভোটে এই এলাকা তথা বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বেশ ভোট পেয়ে প্রমাণে মরিয়া সিপিএম।
সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বারের ভোটে এই এলাকা থেকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় অন্তত হাজার ভোটের ব্যবধান গড়তে হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। ইতিমধ্যে বর্ধমান পুর এলাকার সমস্ত জোনাল ও লোকাল স্তরের নেতাদের বৈঠকে ডেকে এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দলের জেলা নেতৃত্বের তরফে। তাই এই পুরসভার ৩৫টি ওয়ার্ডেই প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা।
গত সেপ্টেম্বরে বর্ধমান পুরসভার ভোটে তৃণমূল জিতেছিল ৩৫-০ ফলে। কিন্তু ভোটের দিন সকালে, অধিকাংশ ভোটার বুথে পৌঁছনোর আগেই, নিরপেক্ষ ভোটদানের পরিস্থিতি নেই অভিযোগ করে প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয় বামফ্রন্ট। কোনও ওয়ার্ডে ইভিএমের সামনে এক বহিরাগত দাঁড়িয়ে রয়েছেন, মোবাইলে তোলা এই ছবি দেখিয়ে সিপিএমের নেতারা দাবি করেন, সমস্ত বুথে প্রচুর ছাপ্পা ভোট পড়ছে।
সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব তখন জানিয়েছিলেন, প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দলের রাজ্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দলের একটি সূত্রে খবর, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও জোনাল বা লোকাল নেতৃত্বের সঙ্গেই কথা বলা হয়নি। জোনাল ও লোকাল স্তরের অনেক নেতার দাবি, পুরভোটের আগের দিন বৈঠক করে জেলা নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, ভোটে তৃণমূল ‘সন্ত্রাস’ করলে প্রতিরোধে যাওয়া হবে না। কারণ, সেক্ষেত্রে দলীয় কর্মীরা আক্রান্ত হতে পারেন। তাই ‘সন্ত্রাস’ শুরু হতেই তাঁরা রাজ্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। এমনকী, দলের পলিটব্যুরো এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি। পলিটব্যুরো নেতারা দলের রাজ্য নেতৃত্বের কৈফিয়ত চান। ফলে সমস্যায় পড়তে হয় সিপিএমের জেলা নেতাদের। দলের এক জোনাল নেতার অভিযোগ, পুরভোটে প্রতিটি বুথে প্রচুর ছাপ্পা ভোট দিয়ে জেতে তৃণমূল। স্থানীয় প্রশাসন তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মদত দেয় বলেও অভিযোগ।
লোকসভা ভোটে বুথে থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এই ভোট ভাল ফল করতে পারলে মুখরক্ষা হবে বলে মনে করছেন শহরের সিপিএম নেতারা। তাঁদের মতে, যদি পুরসভার ৩৫টি ওয়ার্ডে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী সাইদুল হক লিড পান, তাহলে মানুষকে বলা যাবে, পুরভোট অবাধে হলে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা জিততে পারতেন। পুরবোর্ডও দখলে থাকত তাঁদের। সেই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল, তা প্রমাণের জন্য এই ভোট গুরুত্বপূর্ণ বলে করছেন সিপিএমের জেলা নেতৃত্বও।
২০০৯ লোকসভা ভোটে বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রার্থী নার্গিস বেগম পেয়েছিলেন ৭৮,১১৫ ভোট। সিপিএমের সাইদুল হক পান ৭৮,০১৬ ভোট। লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র এখানেই সে বার পিছিয়ে ছিল সিপিএম। ২০১১ বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পান ১,০৬,৮৬৯ ভোট। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী সিপিএমের নিরুপম সেনকে তিনি ৩৭,৪৫৪ ভোটে হারান। বর্ধমান শহরের ৩৫টি ওয়ার্ডেই তৃণমূল সিপিএমের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে পুরভোটে তৃণমূল পায় মোট ১,৪১,২৬৬ ভোট। বাম প্রার্থীরা পান মোট ৩০,৬৫৮ ভোট। অর্থাত্, ব্যবধান ছিল ১,১০,৬০৮।
এত বড় ব্যবধান মোছার জন্য কী ভাবে উদ্যোগী হচ্ছেন তাঁরা? সিপিএমের বর্ধমান জোনাল সম্পাদক তাপস সরকারের দাবি, “আমরা সমস্ত ভয়-ভীতি কাটিয়ে উঠেছি। প্রতি দিন শহরের সমস্ত ওয়ার্ডে আমাদের কর্মীরা মিছিল করছেন। সন্ত্রাসের প্রতিরোধও শুরু করেছি আমরা। মানুষ দেখেছেন, পুরভোটে কী ভাবে ভোট লুঠ হয়েছে। ঠিক মতো ভোট দিতে পারলে, তাঁরাই আমাদের জেতাবেন।”
তৃণমূলের জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথের পাল্টা বক্তব্য, “সন্ত্রাসের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। সিপিএম নেতারা বুঝছেন না, মানুষ ওদের ত্যাগ করেছেন।”