কোথাও পড়ুয়া সংখ্যা কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রাতঃবিভাগ। আবার কোথাও পড়ুয়া না থাকায় অন্য শাখার ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকেরাবর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কলেজে বি কম পাস ও অনার্স বিভাগের হাল এমনই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমান, এসএসসিতে চাকরির সুযোগ না থাকাতেই বাণিজ্য শাখায় আগ্রহ হারাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। আর শূন্য আসন পড়ে থাকছে বছরের পর বছর।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে যে সব কলেজে স্টার পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাও সবসময় ভর্তির সুযোগ পেত না, সেখানে এখন সেকেন্ড ডিভিশন পাওয়া পড়ুয়াদেরও অনায়াসে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। তবুও বাণিজ্য শাখায় ভর্তির আগ্রহ নেই পড়ুয়াদের। এমন কলেজও রয়েছে, যেখানে বাণিজ্যের শিক্ষকেরা অন্য বিভাগে ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ সমূহের পরিদর্শক দেবকুমার পাঁজা বলেন, “কমার্স পড়ে আমাদের রাজ্যের বাইরে প্রচুর কাজের সুযোগ রয়েছে। এখানেও বাণিজ্য শাখার কৃতী ছাত্রছাত্রীরা ভাল চাকরি পেতে পারেন। কিন্তু অনাগ্রহের কারণে এখন বাণিজ্য বিভাগে পড়তে আসছেন না অনেকেই।” তাঁর দাবি, পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে চলতি বছর কোনও কলেজে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে উচ্চমাধমিক পাশ করার পরে ছেলেমেয়েরা এক বছর অপেক্ষা করতে চাইছেন, কিন্তু কমার্সে ভর্তি হতে চাইছেন না।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯৩টি কলেজ রয়েছে। তারমধ্যে ৪৯টি কলেজেই রয়েছে বাণিজ্য বিভাগ। এর মধ্যে ২-৩টি শহরের কলেজ ছাড়া অন্যগুলিতে অর্ধেক আসনও পূরণ হচ্ছে না বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে। বর্ধমান রাজ কলেজের মতো নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তথা বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক তারকেশ্বর মণ্ডল বলেন, “আমাদের কলেজে বাণিজ্য বিভাগে চারজন শিক্ষক অ্যাকাউন্টেন্সি ও চারজন ফিন্যান্স পড়ান। এ ছাড়াও পাঁচজন আংশিক সময়ের শিক্ষক রয়েছেন।” তিনি জানান, আগে সকালে বি কম পাস পাঠ্যক্রমের ক্লাস হত আর সান্ধ্য শাখায় বসত বি কম ও ফিন্যান্স অনার্সের ক্লাস। কিন্তু ছাত্র কমে যাওয়ায় এখন বি কম প্রাতঃবিভাগটিকে সন্ধ্যায় ক্লাস করানো হচ্ছে। তাঁর দাবি, “আগে কর্মাস পড়ে চাকরি পাওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। ব্যাঙ্ক, বিভিন্ন শিল্প সংস্থা, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রথম সুযোগ পেতেন কমার্সের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু এখন বাছবিচার না রেখে যে কোনও পাঠ্যক্রমের পড়ুয়ারাও ওই সমস্ত পরীক্ষা দিতে পারছেন। নিয়োগও সবমিলিয়েই হচ্ছে। এতেই কমার্স পাঠ্যক্রমের ছাত্রছাত্রীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।” তারকেশ্বরবাবুর আফশোষ, “কৃতির কদর সবসময়েই রয়েছে। কিন্তু তেমন ভাল ছাত্র ভর্তি হচ্ছে কই?”
রাজ কলেজের সান্ধ্য শাখার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক শেখ সেলিমও বলেন, “আমাদের সান্ধ্য শাখায় অনার্সের ২২৩টি আসনের মধ্যে ১৮০টিতে ছাত্র ভর্তি হয়েছে। পাশের আসন ৪০০। সেখানে ১২০ জন ভর্তি হয়েছেন।” তিনি জানান, দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ পেলেই আমরা তাঁকে বাণিজ্য শাখায় অনার্স নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি। কিন্তু তাতেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রতি বছর প্রচুর ছাত্র সংখ্যাতত্ব ও গণিতে অকৃতকার্য থাকছে। বহু বার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দফতরের কাছে এ বিষয় জানিয়েও ফল মেলেনি বলে তাঁর দাবি।
বর্ধমানের উপকণ্ঠ হাটগোবিন্দপুরের ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ৪৭টি অনার্স ও ১১৯টি পাস পাঠ্যক্রমের আসন রয়েছে। তবে দুটি মিলিয়ে মাত্র ২৬ জন ভর্তি হয়েছে এ বার।” বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষকেরা আপাতত অন্য বিভাগে গণিতের ক্লাস নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
কমবেশি একই ছবি আউশগ্রামের গুসকরা মহাবিদ্যালয়ে। অনার্সে ৬৮ ও পাসে ৩১৪টি আসন রয়েছে। কিন্তু চলতি বছরে ভর্তি হয়েছে মাত্র ২৫ জন। অধ্যক্ষ স্বপনকুমার পানের আশঙ্কা, এমন চললে বিভাগ টিকিয়ে রাখা মুশকিল। একই অবস্থা চন্দ্রপুর, সিউড়ি বিদ্যাসাগর, মন্তেশ্বর গৌরমোহন ইত্যাদি অনেক কলেজেরই। একমাত্র হুগলি মহসিন কলেজের অবস্থা কিছুটা হলেও ভাল। সেখানে অনার্সের ৫৩ ও পাশের ১২১টি আসনের প্রায় বেশিরভাগই পূরণ হয়েছে এ বার।
কিন্তু তাহলে বাণিজ্যে ছাত্রছাত্রীদের বসত বাড়াতে উপায়?
কলেজ অধ্যক্ষদের মতে, স্কুলে স্কুলে গিয়ে একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নিয়ে বারবার কর্মশালা করতে হবে। প্রয়োজনে ওই কর্মশালায় অভিভাবকদেরও ডাকতে হবে। কর্মশালায় বাণিজ্য শাখা নিয়ে পড়াশোনা করে কী করা যেতে পারে, কোথায় কোথায় চাকরির সুযোগ রয়েছে সে সবও বোঝানো হবে। তবে সরকারকেও এই সমস্যা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। দেবকুমারবাবুর কথায়, “আমরা কলেজগুলির বাণিজ্য বিভাগের এমন ছাত্রহীন অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন। উচ্চশিক্ষা দফবতরের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্র ভর্তি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় ওই বিভাগটির আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যু ঘটবে।”