গত বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির মধ্যেও যে ক’টা আসন এ জেলায় সিপিএমের মান বাঁচিয়েছিল, তার একটি রায়না।
আবার লোকসভা ভোটে তৃণমূল জেলায় যে ক’টি বিধানসভা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল, তার অন্যতম রায়না।
তিন বছরের মধ্যে রায়নার এই ভোল বদলে রয়েছে ভূতের খেল— অন্তত এমনটাই দাবি বিরোধীদের। তাঁদের অভিযোগ, ‘ভূতে’র কারসাজিতে বালতি করে নয়, একেবারে পাম্প চালিয়ে সিপিএমের পুকুরের জল তৃণমূলের পুকুরে গিয়েছে। এক দিকে জল কমতেই অন্য পুকুরের জল স্ফীত হয়েছে।
এ বার জল মাপার খেলায় তৃণমূলের হয়ে ফের মাঠে নেমেছেন নেপাল ঘড়ুই। যিনি গত বিধানসভা ভোটে বারো হাজারেরও বেশি ভোটে সিপিএমের বাসুদেব খানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। উল্টো দিকেও প্রার্থী রয়ে গিয়েছেন বিদায়ী বিধায়ক বাসুদেববাবু। আবার মোদী হাওয়ার গতি কমলেও রায়নার মাঠে ঘোরাঘুরি করছেন বিজেপি প্রার্থী কাশীনাথ পাত্র। তবে, প্রার্থী নিয়ে দলের একাংশেই ক্ষোভ, নানা বিষয়ে নেতা-কর্মীদের মতানৈক্যে এ বারে ভূতেরা পাম্প চালিয়ে জল তুলবে কি না, তা নিয়ে তৃণমূলের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে।
যদিও তৃণমূলের একাংশ নেতা-কর্মীদেরই মত, বৈশাখের কাঠফাটা গরমে বেঁচে থাকতে গেলে পুকুর পাড়ে বাঁধ দিয়ে জল যেমন আটকাতে হবে, তেমনি অন্য পুকুরের জলও নিতে হবে। তাঁরাই জানাচ্ছেন, তৃণমূলের এই ‘জল ভরো’ কর্মসূচিতে সাধারণত যাঁরা যোগ দেন, তাঁরা নানা কারণে ঢিল দিতেই সিপিএম রায়নার বিভিন্ন গ্রামে বন্ধ পার্টি অফিস খুলে। নির্বাচনী কাজ শুরু করে দিয়েছে। ২০১১ সালের পর থেকে যে সব জায়গায় সিপিএম নেতারা পা দিতে পারেননি সেখানেও বড় মিছিল, জোর প্রচার চলছে। অর্থাৎ জল যাতে কেউ না তুলতে পারে, তার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন নেতারা।
রায়নার বাসিন্দা তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য উদয় সরকার বলেন, “এ বার আর জল ঢালতে দেব না। মানুষই প্রতিরোধ করবেন। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারলে, আমাদের জয় নিশ্চিত।”
দামোদরের দক্ষিণ পাড়ের এ আসনটি বরাবরই বামেদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তবে বাম আমলের আগে ১৯৬২, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে এই আসন থেকে কংগ্রেস জিতেছিল। গতবার পরিবর্তন জমানাতেও এই আসন থেকে সিপিএম প্রার্থী বাসুদেব খান ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। জয়ের ব্যবধান ছিল ১২ হাজারের বেশি। আবার তিন বছর পরে লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূল প্রার্থী সুনীল মণ্ডল ৫১ শতাংশ ভোট পান। ৩১ হাজারের বেশি ভোটে জেতেন তিনি। সিপিএমের ভোট কমে প্রায় ৩৫ শতাংশ। উদয়বাবুর দাবি, ‘‘পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে, বুথ লুঠ ছাড়া এই হিসেব অসম্ভব।” পরিসংখ্যানই বলে, রায়না বিধানসভার ৯ নম্বর বুথে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৯২টি, তিন বছর পর সেই ভোট দাঁড়ায় ২১টিতে। একই ভাবে ১০, ১৩, ১৮, ২০ ও ২১, ২২ নম্বর বুথে সিপিএমের ভোট ছিল যথাক্রমে ৩০৪, ২৬২, ৫৭৬, ৩৬০, ৬১৭, ৪৪৪টি। লোকসভায় ওই সব বুথে সিপিএমের ঘরে পড়ে কোথাও ৪০ কোথাও ১৫ আবার কোথাও ২৮টি ভোট। আবার ২৭৯ থেকে ২৮২, এই চারটি বুথের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে, লোকসভা নির্বাচনে ওই সব বুথে সিপিএমের হয়ে বোতাম টিপেছেন ৮৯, ৫২, ২৫, ৩০ জন। সেখানে তৃণমূল ভোট পেয়েছে ৫০০-৬০০ করে।
কয়েক মাস আগেই রায়নার শ্যামসুন্দরে বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় উচিতপুরের সিপিএম কর্মী স্বপন মালিকের। তাঁর জন্য স্মরণসভা করে গিয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। সিপিএমের প্রচারেও বলা হচ্ছে, সকলের জন্য খাদ্যের দাবিতে সে দিন বিডিওর কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। তৃণমূল ভয় পেয়ে নিরীহ কর্মসূচীতে বোমা মেরে দলের একজন কর্মী খুন করেছে। সিপিএমের দাবি, সেই ঘটনার পরেই দলের কর্মীরা ঘর ছেড়ে পথে নেমেছে। একের পর এক দফতরের তালা খুলেছে। একসময় যে গ্রামে পা ফেলা যেত না, সেখানে প্রচারে গিয়েও প্রার্থীরা সাড়া পাচ্ছেন।
তবে বুথ লুঠ, জল ঢালার কথা কোনও ভাবেই মানতে চাননি তৃণমূল নেতারা। তাঁদের দাবি, নিজেদের আমলের সন্ত্রাসের গল্প তাঁদের ঘাড় চাপাচ্ছে সিপিএম। তৃণমূলের জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক গোলাম জার্জিস থেকে রায়না ১ ব্লকের সভাপতি শৈলেন সাঁইয়ের দাবি, “বুথ লুঠ ওদের আমলে হতো। আমাদের সময় মানুষ নিজের ভোট নিজে দেন।’’ রায়নায় মানুষের জোটেই সিপিএম ধরাশায়ী হবে বলেও তাঁদের দাবি।