জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনার পরে গাড়িটি। নিজস্ব চিত্র
বাড়ির ছোটদের নিয়ে হই হই করতে করতে আউশগ্রামের জয়রামপুরে মাজারে সিন্নি চড়াতে গিয়েছিলেন ন’জন। ফেরার পথে শুক্রবার সকাল ১০টা নাগাদ গলসি চৌমাথায় দু’নম্বর জাতীয় সড়কের উপর চাকা ফেটে গাছে ধাক্কা খেয়ে প্রায় ফুট দশেক ছিটকে যায় গাড়িটি। ঘটনাস্থলেই মারা যান চালক শেখ নুরমহম্মদ ওরফে সুরজ (৩২)। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় মামা-ভাগ্নি, আজহার মল্লিক (২৪) ও চার বছরের তামান্না খাতুনের। প্রত্যক্ষদর্শী ও গাড়িতে থাকা অন্যদের দাবি, চালক অত্যন্ত জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তার জেরেই এই দুর্ঘটনা।
মৃত তিন জন ছাড়াও ওই গাড়িতে ছিলেন গলসির শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মৌসুমি, তাঁর স্বামী সাদ্দাম শেখ ও তাঁদের আট মাসের মেয়ে সায়ন। ছিলেন মৌসুমীর দাদা, বৌঁইচা গ্রামের আজাহার মল্লিক ও মশারফ মল্লিক এবং মশারফের স্ত্রী বৈশাখি ও তাঁদের আড়াই বছরের ছেলে সৌরভ। মৃত আজাহারও মৌসুমীর দাদা হন। আর তামান্না তাঁদের বোনঝি। এ দিন পুরসা হাসপাতালে ছেলেকে আঁকড়ে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন মৌসুমী। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। কোনওরকমে তিনি বলেন, “মাজার থেকে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। গাড়িটি গতি খুব বেশি ছিল। বড় ভাই আজাহার ও বোনজি তামান্না সামনে সিটে বসে ছিল। আমি আমার স্বামী ও ছেলে পেছনে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ পাই। গাড়িটা পুরো দুলে ওঠে। ছেলেকে জাপটে ধরে সিটের নীচে মাথা গুঁজে দিয়েছিলাম। সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাড়িটি একটি গাছে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশেই আটকে গিয়েছিল। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে। স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলেন। মৌসুমী, তাঁর স্বামী সাদ্দাম ও তাঁদের মেয়েকে নিয়ে যাওয়া পুরসায়। বাকি ছ’জনকে নিয়ে যাওয়া বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। প্রত্যক্ষদর্শী, গ্যারাজ মিস্ত্রি রানা মোল্লা ও বাইক আরোহী কামরুল হাসানরা বলেন, “গাড়িটি দ্রুত গতিতে আসছিল। টায়ার ফেটে যেতেই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উড়ে গিয়ে গাছে ধাক্কা মারে।’’
বড় ছেলে, নাতনিকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নূরজাহান বিবি। নিজস্ব চিত্র
গত দেড় মাসে গলসি থেকে পারাজ মোড় পর্যন্ত এলাকায় পরপর বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বারবার দাবি ওঠায় রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে পুলিশ। তবে এলাকাবাসীদের অভিযোগ, এ দিন দুর্ঘটনার সময়ে রাস্তার পাশে পুলিশ বা সিভিক কর্মী কাউকেই দেখা যায়নি। গতিতে লাগাম টানার কেউ না থাকায় গাড়িটি অত জোরে ছুটছিল বলেও তাঁদের দাবি। পুলিশ যদিও নজরদারি না থাকার কথা মানেনি। সাদ্দাম, মৌসুমীও বলেন, ‘‘গাড়িতে অনেকেই বমি করছিল। কোলকোল মোড় পেরোনোর পর থেকেই চালক রেগে খুব জোরে গাড়ি চালাতে শুরু করেন। নিষেধ করলেও শুনছিলেন না।’’
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গিয়েছে বড় ছেলে, নাতনি। আর এক ছেলে, বৌমা, মেয়ে-জামাই সবাই হাসপাতালে ভর্তি। খবর শুনে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন নূরজাহান বিবি। পড়শি, আত্মীয়েরা ঘিরে রেখেছেন তাঁকে। মৃত্যুভয় কাটছে না বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি মুশারফ ও তাঁর স্ত্রী বৈশাখীরও। বৈশাখী বলেন, ‘‘আমার আর ননদের ছেলে অনেকদিন থেকে ভুগছিল। তাই মাজারে নিয়ে গিয়েছিলাম। এ ভাবে বাড়ির আর একটা শিশুকে হারানো মেনে নিতে পারছি না।’’