—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কয়েক দিন আগেই অনলাইন গেমের ফাঁদে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল বর্ধমানের এক কিশোরের। গেমের নিয়ম মেনে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে মৃত্যু পরখ করতে গিয়ে সত্যিই প্রাণ যায় তার। অভিভাবকেরা পরে জানতে পারেন, ছেলের সহপাঠীদের অনেকেই এই খেলার সঙ্গে পরিচিত। যদিও পুলিশ বা সাইবার থানার কাছে ওই মারণ খেলা নিয়ে বিশেষ কোনও তথ্য ছিল না। চিকিৎসকদের দাবি, মোবাইলে অনলাইন গেম তো বটেই মোবাইল ব্যবহার করা নিয়ে বাড়িতে অশান্তির জেরেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেক কমবয়সী ছেলেমেয়ে। উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবকদের। অনেকেই কৈশোরে পৌঁছনো ছেলেমেয়েকে শাসন করতে ভয় পাচ্ছেন।
বর্তমান সময়ে মোবাইল অত্যন্ত জরুরি এবং দৈনন্দিন জীবনের অংশ। যোগাযোগ ছাড়াও কাজকর্ম,
গৃহস্থালীর জিনিস কেনা, টিকিট কাটা, অবসর সময় কাটানো থেকে পড়াশোনাতেও মোবাইল দরকার হচ্ছে। ফলে দিনে একটা নির্দিষ্ট সময় মোবাইল থাকছে অনেক স্কুল পড়ুয়াদের হাতে। সেই সময় শুধু প্রয়োজনীয় কাজ না করে অনেকেই নানা ভিডিয়ো, গেমে ঢুকে পড়ছে। অভিভাবকদের পক্ষেও হয়তো সব সময় নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার তাপস ঘোষ বলেন, ‘‘মোবাইল নিয়ে ভাই-বোনের মধ্যে অশান্তি, বাবা বা মা হঠাৎ মোবাইল কেড়ে নিলে বা মোবাইল কিনে দেওয়ার বায়না না পূরণ করলে আত্মঘাতীও হচ্ছে অনেক নাবালক, নাবালিকা। হাসপাতালের বেশ কিছু এই ধরনের ঘটনা এসেছে। অনলাইন মারণ গেমের নেশা থেকেও দুর্ঘটনা ঘটছে। সতর্ক থাকতেই হবে।’’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া ২০২১ সালের জুন মাসের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ আত্মহত্যা। আর আত্মহত্যার কারণ হল, অত্যধিক মোবাইল ফোন ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না হওয়া, প্রণয়ঘটিত কারণ বা নেশায় জড়িয়ে পড়া। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ দাঁ বলেন, ‘‘এটা সত্যি যে কমবয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। মোবাইলের মধ্যে দিয়ে এত বৃহত্তর একটা জগৎ খুলে যাচ্ছে যার ভাল, খারাপ দুই রয়েছে।’’
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো অনুযায়ী, ২০২২ সালে যা আত্মহত্যার সংখ্যা তার মধ্যে বালক- কিশোরদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত অনেকেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি করছেন। এই প্রবণতা ভাবাচ্ছে অভিভাবকদের। সুত্তম রুইদাস, উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়েরা বলেন, ‘‘করোনার পরে মোবাইল নির্ভরতা বেশি বেড়ে গিয়েছে। বড়রা ছুটছে। ছোটদের সঙ্গে যে ফাঁক তৈরি হচ্ছে, সেটাই সর্বনাশ ডেকে আনছে।’’ বর্ধমান শহরের রথতলা মনোহর দাস বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি প্রকল্পের ঘোষণাগুলি অভিভাবক বা পড়ুয়াদের গ্রুপে দেওয়া ছাড়া ফোনে মেসেজ দিয়ে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তি জানানো বন্ধ করেছি। যাতে এই বাহানায় ছোটরা ফোন না নেয়। তবে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ছেলেমেয়ে মোবাইলে কী দেখছে, সে দিকে নজর দিতেই হবে।’’
এ বছর সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দ হিসাবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বেছে নিয়েছে ‘ব্রেন রট’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় মস্তিষ্কের পচন। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ক্রমাগত হরেক রকমের অগভীর ও অবান্তর তথ্য আর কথা দেখে, শুনে এবং পড়ে মানুষের মগজ অসাড় হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে গভীর ভাবে ভাবতে ভুলে যাচ্ছে মানুষ। এক কথায় মগজে পচন ধরছে। যে বয়সে মস্তিস্ক সবচেয়ে সক্রিয়, সেই সময়টাকে কি এ ভাবে পচনের দিকে যেতে দেওয়া যায়? (চলবে)