জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠকের পরে শিক্ষকেরা। নিজস্ব চিত্র।
এক সভাতেই সরলেন দু’জন। এক জন রাজ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিজয় চন্দ। অন্য জন কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি সুভাষ সোম। এরা দু’জনেই প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তারকেশ্বর মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন।
রাজ কলেজের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে মাসখানেক ধরেই মাঠে নেমেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা। লড়াইয়ের প্রথম ধাপে কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তারকেশ্বর মণ্ডলের বিরুদ্ধে একাধিক, দুর্নীতি তোলাবাজির অভিযোগ তোলেন তাঁরা। শিক্ষকদের চিঠি পেয়ে তদন্তে করে তারকেশ্বরবাবুকে সরিয়েও উচ্চশিক্ষা দফতর। তবে কলেজ থেকে তার প্রভাব কমেনি। শিক্ষকদের অভিযোগ, সেই প্রভাবেই প্রবীণ শিক্ষিকা এবং এক শিক্ষাকর্মীকে কলেজের ভিতর হেনস্থা হতে হয়। একাধিক বৈঠকে ছাত্র সংসদের সঙ্গেও গোলমাল হয়। অবশেষে, আন্দোলন শুরুর এক মাস পরে, বৃহস্পতিবার কাঙ্খিত জয় এসেছে বলে দাবি করছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা।
এ দিন বেলা তিনটের সময় বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের সভাঘরে রাজ কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। সভায় কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি সুভাষ সোম ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিজয় চন্দও হাজির ছিলেন। তবে দেখা যায়নি তারকেশ্বরবাবুকে। সভার শুরুতেই তারকেশ্বরবাবু কী ভাবে একচ্ছত্র ভাবে ‘দমননীতি’তে কলেজ পরিচালনা করতেন, সেই অভিযোগ তুলতে থাকেন শিক্ষকেরা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, স্নাতকস্তরে ভর্তির সময় পড়ুয়াদের কাছ থেকে তারকেশ্বরবাবুর মদতে কিছু বহিরাগত ও বর্তমান ছাত্রেরা হাজার হাজার টাকা দাবি করতেন। টাকা দিতে না পারলে ভর্তি হওয়া আটকে দেওয়া হতো। এ ছাড়া কলেজের নিজস্ব তহবিল থেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে চুক্তিবদ্ধ কর্মী নিয়োগ করেছিলেন তিনি। যাঁরা আদতে তারকেশ্বরবাবুর ‘বাউন্সার’ ছিলেন বলেও শিক্ষকদের দাবি।
গত ৭ জুন কলেজের ৫০ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী তারকেশ্বরবাবুর কাজকর্ম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী, উচ্চ শিক্ষা দফতরে ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছেন। এই সভাতেও বেশ কিছু নতুন অভিযোগ উঠে আসায় জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “একটা তদন্ত কমিটি করে সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।” এরই মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা দাবি করেন, বর্তমানে দায়িত্ব পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিজয় চন্দ তারকেশ্বরবাবুর অনুগামী। তাঁর কথাতেই কলেজ পরিচালনা করা হচ্ছে। গত ৩ জুলাই ওই দু’জনের মদতে চুক্তিবদ্ধ কর্মীরা কলেজের প্রবীণ শিক্ষিকা নিরুপমা গোস্বামীকে মারতে যায়, এমনকী কলজের ভিতর দুই শিক্ষাকর্মীকে মারধর করা হয় বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন। এরপরেই সভায় উপস্থিত ৯৭ জন শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা দাবি তোলেন, ‘‘আমরা কলেজের ভিতর নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। দু’মাসের বেতন পাইনি। কলেজের সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরাতে আমরা বিজয়বাবুর বদল চাই।” বদলি হিসেবে নিরুপমাদেবীর নাম প্রস্তাব করেন তাঁরা।
এক শিক্ষক সরাসরি সুভাষবাবুকে প্রশ্ন করেন, “২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি উচ্চ শিক্ষা দফতর আপনার কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিল, তারকেশ্বরবাবু কেন এখনও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে রয়েছেন। আপনি তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেননি।” এক শিক্ষাকর্মী বলেন, “আপনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও তাঁর অনুগামীদের বাঁচাতে ক্রমাগত মিথ্যা তথ্য পেশ করছেন। আপনি তারকেশ্বরবাবুর অন্যায় কাজকে দিনের পর দিন সমর্থন করে গিয়েছেন।” এরপরেই সভায় আওয়াজ ওঠে, পরিচালন সমিতির সভাপতিকেও গদি ছাড়তে হবে। এক প্রকার বাধ্য হয়ে জেলাশাসকের কাছে পদত্যাগ পত্র দেন সুভাষবাবু। তিনি বলেন, “কলেজের সমস্যা মেটাতে আমি ব্যর্থ। সে জন্য পদত্যাগ করলাম।”
জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “নিরুপমাদেবীর নাম আমরা উচ্চশিক্ষা দফতরে পাঠাচ্ছি। অনুমোদন না আসা পর্যন্ত বিজয়বাবু দায়িত্বে থাকবেন। সুভাষবাবুর পদত্যাগের চিঠি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাঁরাই পরবর্তী সভাপতি নির্বাচিত করবেন।” তখনই নিরুপমাদেবীর দাবি, “আপনি সভাপতি না থাকলে কলেজ পরিচালনা অসম্ভব।” জেলাশাসক বলেন, “আমার কোনও আপত্তি নেই।” জেলাশাসককে সভাপতি হিসেবে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিচালন সমিতির সদস্যেরা।
আর পুরো ঘটনা নিয়ে তারকেশ্বরবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমার সময়ে কলেজে কোনও সমস্যা হয়নি। কয়েকজন মিলে কলেজে অচলাবস্থা তৈরি করেছেন। জেলাশাসকের নেতৃত্বে কলেজে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে এলে পড়ুয়াদের মঙ্গল।”