১৩ অক্টোবর, ২০১৯-এ ‘অবৈধ’ খাদানে তলিয়ে যান তিন
MIning area

বদলেছে সময়, অভাব ‘বদলায়নি’

গ্রাম এখনও ‘ভাল নেই’, জানান মোড়ল সোগেন মারাণ্ডি। তবে তাঁর সংযোজন: ‘‘বাড়িতে হাজার কষ্ট, অভাব। কিন্তু ওই তিন জনের কথা ভেবে আমাদের গ্রামের কেউ কয়লা কাটতে যায় না আর। অনেকে দিনমজুরি করেন। মাসে রোজ কাজ মেলে না।’’

Advertisement

সুশান্ত বণিক

কুলটি শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩৮
Share:

বাঁ দিকে, আকনবাগান গ্রাম। ডান দিকে, এক বছর আগের ওই দিনে এখানেই তলিয়ে যান তিন যুবক। ছবি: পাপন চৌধুরী

১৩ অক্টোবর, ২০১৯। পশ্চিম বর্ধমানের আলডিহিতে ‘অবৈধ’ খাদানে কয়লা কাটতে গিয়ে ভূগর্ভে তলিয়ে গিয়েছিলেন আকনবাগান গ্রামের তিন যুবক। সেই সময়ে, গ্রামবাসী এক জোটে দাবি করেছিলেন, রুটি-রুজি প্রায় কিছুই নেই। বাধ্য হয়েই ওই কাজ করতে হয়। অভিযোগ, সেই সময়ে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছিল কাজের। কিন্তু আশ্বাসই সার,আক্ষেপ গ্রামবাসীর।

Advertisement

ওই ঘটনার এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে আকনবাগানে গিয়ে দেখা গেল, ইতিউতি বট আর নিম গাছের ছায়ায় জনা কয়েক যুবকের জটলা। দেখা নমনি কিস্কুর সঙ্গেও। বললেন, ‘‘স্নানে গিয়েছিলাম। ছেলেটার ছবিতে মালা দেব।’’ ছেলে, কালীচরণ কিস্কু। এক বছর আগে সঙ্গী বিনয় মুর্মু, সন্তোষ মারাণ্ডি ও আর এক জনের সঙ্গে কয়লা কাটতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনার ছ’দিনের মাথায় মিলেছিল তিন জনের দেহ। গাছের ছায়ায় বসা যুবকেরাও ততক্ষণে ওই সময়পর্বটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন।

আলোচনায় কান পাততেই শোনা গেল, ক্ষোভের স্বরও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন যুবক জানালেন, এক বছর আগের ওই ঘটনার সময়েও গ্রামের যুবকেরা বেকার ছিলেন। এখনও তা-ই তাঁরা। নেই রেশন কার্ড, বিপিএল কার্ড। ‘একশো দিনের প্রকল্প?’ শুনতেই ফোঁস করে উঠে এক যুবক বলেন, ‘‘ও সব এখানে হয় না। পুজোর মরসুমে ভাল থাকতেই ওই তিন জন কয়লা কাটতে গিয়েছিল।’’ গ্রাম এখনও ‘ভাল নেই’, জানান মোড়ল সোগেন মারাণ্ডি। তবে তাঁর সংযোজন: ‘‘বাড়িতে হাজার কষ্ট, অভাব। কিন্তু ওই তিন জনের কথা ভেবে আমাদের গ্রামের কেউ কয়লা কাটতে যায় না আর। অনেকে দিনমজুরি করেন। মাসে রোজ কাজ মেলে না।’’

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে বিজেপি নেতা লক্ষ্মণ ঘোড়ুইয়ের টিপ্পনী, ‘‘গতবার আমরা দলীয় ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। রাজ্য সরকার যে উন্নয়নের ফাঁকা বুলি আওড়ায়, তা ওই গ্রামে গেলেই বোঝা যায়।’’ সিপিএম নেতা বংশগোপাল চৌধুরীও বলেন, ‘‘তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার এলাকার তথা রাজ্যের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ, তা আবার বোঝা গেল।’’

অথচ, ২০১৯-এর এই সময়ে প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, গ্রামবাসীকে একশো দিনের প্রকল্পে কাজ দেওয়ার, বিপিএল কার্ড বানিয়ে দেওয়ার। সমস্যা ‘শুনতে’ বারবার গ্রামে দেখা গিয়েছে প্রশাসনের কর্তাদেরও। গ্রামের বৃদ্ধ রবি মুর্মু বলেন, ‘‘ও সব কথার কথা। কেউ কিছুই পাননি।’’ গত বছর ওই ঘটনায় কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছিলেন এক যুবক। এ দিন তিনি জানান, একটি সংস্থায় দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন। ‘‘প্রশাসন কথা রাখল কই,’’ আক্ষেপ তাঁর।

বিপিএল কার্ড ও একশো দিনের প্রকল্পে কাজ দেওয়ার দায়িত্ব আসানসোল পুরসভার। এই দু’টি কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা পুরসভার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার সুকোমল মণ্ডল কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারির দাবি, ‘‘কোথাও একটা যোগাযোগের অভাব থাকায় এমনটা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’ জেলাশাসক (পশ্চিম বর্ধমান) পূর্ণেন্দু মাজি বলেন, ‘‘পুরসভা এলাকায় আমরা একা কিছু করতে পারব না। পঞ্চায়েত হলে এখনই ব্যবস্থা করা যেত। তবে মেয়রের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ করছি।’’

‘পদক্ষেপ’ কবে করা হয়, তা নিয়ে আর আগ্রহ বা অপেক্ষা কোনওটাই নেই বছর ৭২-এর বৃদ্ধা সাতমণি মারাণ্ডির। তিনি ওই ঘটনায় মৃত সন্তোষের মা। গ্রামের ঠিক মাঝে বাড়ির দাওয়ায় বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতেই জানান, সন্তোষের স্ত্রী বাপের বাড়ি গিয়েছেন। এই মুহূর্তে একাই দিন কাটছে। সন্তোষের বাড়ির অদূরেই আরেক জন মৃত বিনয়ের বাড়ি। সেখানে গিয়ে জানা গেল, স্বামীকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন স্ত্রী প্রতিমাদেবী। তিন নাবালক ছেলেমেয়েকে রেখে তিনি মারা গিয়েছেন। প্রয়াত ওই দম্পতির তিন সন্তান রবীন, শুকদেব ও শিবানীকে সম্প্রতি নিয়ে গিয়েছেন তাঁদের এক নিকটাত্মীয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement