এ ধরনের ‘প্যাড’ দিয়েই চলত কয়লা পরিবহণ। নিজস্ব চিত্র
নব্বইয়ের দশক। পশ্চিম বর্ধমানের নানা প্রান্তে গজিয়ে উঠল অবৈধ কয়লা খাদান। কয়লা চুরি কার্যত প্রকাশ্যেই চলত বলে অভিজ্ঞতা শিল্পাঞ্চলের বহু মানুষেরই। কয়লা-ক্ষেত্রের জড়িতদের একাংশের সূত্রেই জানা গেল, উত্তরপ্রদেশ, কলকাতা, এমনকি, নেপালেও এই কয়লা পাচার করতে ভরসা ছিল ‘দাদার’ চিহ্ন দেওয়া সাঙ্কেতিক কাগজ, যা স্থানীয় ভাবে ‘প্যাড’ হিসাবে পরিচিত ছিল। এই প্যাড বিষয়টি সদ্য নিহত কয়লা কারবারি রাজেশ ওরফে রাজু ঝায়ের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল, দাবি পুলিশের একটি সূত্রের।
জেলার কয়লা-ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিতেরা জানাচ্ছেন, নব্বইয়ের দশকে জেলার নানা প্রান্তে ইসিএলের পরিত্যক্ত খনি ও লিজ় হোল্ড (মাটির তলায় কয়লা আছে এমন এলাকা) এলাকায় অবৈধ খনন শুরু হয়। মূলত, জয়দেব মণ্ডলের নেতৃত্বে ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে এই কয়লা খনন চলতে থাকে বলে অভিযোগ। কয়লা-চুরি সংক্রান্ত সিবিআইয়ের করা মামলার চার্জশিটেও নাম রয়েছে জয়দেবের। তবে এই মুহূর্তে তিনি জামিনে মুক্ত। জয়দেবের এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজু। রাজুর উপরে দায়িত্ব ছিল অবৈধ কয়লা বোঝাই ট্রাক, ডাম্পার পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানো। অবৈধ কয়লা ‘নিরাপদে’ পাঠাতেই রাজু প্রবর্তনকরেন প্যাডের।
ঘটনা হল, কয়লা কারবারের রাশ বদল হয়েছে সময়ের সঙ্গে। সিবিআই সূত্রের দাবি, কয়লা-সিন্ডিকেটের মাথায় বসেছিল অনুপ মাজি ওরফে লালা। লালার সময়ে কয়লা পরিবহণের দায়িত্ব চলে যায় রত্নেশ বর্মার হাতে। কিন্তু লালার আমলে কয়লা তো বটেই, তাঁর বালি কারবারেও প্যাড বিষয়টি ছিল। সিবিআই, ইডি সূত্রে অতীতে দাবি করা হয়েছে, এই প্যাড থাকলে ট্রাক, ডাম্পার চালকদের কোনও পুলিশি তল্লাশির মুখে পড়ত না। ঘটনা হল, সিবিআই কয়লা-তদন্ত শুরু করার পরে, আসানসোল, দুর্গাপুর, নিতুড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় কাজ করে যাওয়া কয়েক জন পুলিশকর্মী ও আধিকারিকদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। তবে এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের জমা করা চার্জশিটে পুলিশের কারও নাম নেই। তবে প্যাডের বিষয়টির উল্লেখ আছে চার্জশিটেও।
এই প্যাড বিষয়টি কী? সিবিআইয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, রাজু ও জয়দেব মণ্ডলের সিন্ডিকেটের কয়লা রাস্তা দিয়ে পরিবহণের সময় সেগুলি যে তাঁদেরই, সে প্রমাণ দিতে পথে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের একাংশকে একটি বিশেষ সাঙ্কেতিক চিহ্ন বিশিষ্ট কাগজ দেখানো হত। যাতায়াতে ছাড় মিলত তার পরেই। শিল্পাঞ্চলে কাজ করে যাওয়া একাধিক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানাচ্ছেন, কোন দিন কাগজে কী সঙ্কেত থাকবে, কতগুলি ট্রাক অবৈধ কয়লা নিয়ে যাবে, এ সব ঠিক করতেন রাজু। সাঙ্কেতিক চিহ্ন ও গাড়ির নম্বর রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের জানিয়েদিতেন রাজু।
এই সাঙ্কেতিক চিহ্নে কখনও দেবতা, কখনও পশুপাখি, আবার কখনও ফল, ফুলের ছবি ব্যবহার করা হত। অত্যন্ত গোপনীয় ভাবেই এই কাজটি করতেন রাজু। পুলিশ সূত্রটি জানাচ্ছে, সাধারণত ইসিএলের কয়লা পরিবহণের সময় গাড়ির চালকের কাছে সংস্থার ছাপ দেওয়া চালান ও ডিও (‘ডেসপ্যাচ অর্ডার’) থাকে। অবৈধ কয়লার গাড়িতে সে সব থাকার বালাই নেই। ফলে রাজু ও জয়দেবের সিন্ডিকেটের বাইরে অন্য কেউ যাতে অবৈধ কয়লা পাচার করতে না পারে, সে জন্যও এই প্যাড-প্রথা।