পরিবর্তনের প্রথম জমানায় বর্ধমান জেলায় সিপিএমকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিল গুসকরা।
২০০৮ সালে সিপিএমের কাছ থেকে পুরসভার দখল নিয়েছিল তৃণমূল। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও পিছু ধরেছিল তখন থেকেই।
আট বছর পরে গুসকরা তৃণমূলেরই। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুধু বেড়েছে বহু গুণ। প্রায় প্রতিদিনই তৃণমূল কাউন্সিলরদের দলাদলির নমুনা পাচ্ছেন গুসকরার মানুষজন। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে পুরপ্রধানকে সরাতে চেয়ে দুই গোষ্ঠীর গোলমাল বারেবারে প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। শহরের বাসিন্দারা ক্ষোভ জানিয়েছেন, পথে নেমেছেন, প্রশাসনও একাধিক বৈঠক করেছে। কিন্তু নিট ফল শূন্যই ফেরা যাক ২০০৮ সালে। তখন পুরপ্রধান ছিলেন চঞ্চল গড়াই। উল্টো দিকে ছিলেন নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও মল্লিকা চোঙদারের ‘জুটি’। দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে পুর-উন্নয়ন কার্যত শিকেয় উঠেছিল। উন্নয়ন খাতের বহু টাকা পুরসভার ঘরেই পড়েছিল। কাউন্সিলরেরাই বলাবলি করতেন, পুরবোর্ডের সভা মানেই তৎকালীন উপপুরপ্রধান মল্লিকাদেবীর সঙ্গে পুরপ্রধান চঞ্চলবাবুর সংঘাত অনিবার্য।
এই টালবাহানার মধ্যেই ২০১৩ সালে ফের পুরনির্বাচন হয়। এ বার পুরপ্রধান, উপপুরপ্রধানের সঙ্গে দলের টিকিট পান নিত্যানন্দবাবুও। তবে তিনি দলের শহর সভাপতি থাকা সত্ত্বেও গুসকরা পুরসভার প্রার্থীদের নাম ঘোষণার সময় মুকুলবাবু নিত্যানন্দবাবুর নাম নেননি। অভিযোগ ছিল, চঞ্চলবাবু প্রার্থী তালিকা থেকে নিত্যানন্দবাবুর নাম মুছে দিয়েছিলেন। পরে ভোটের ফল বেরোলে দেখা যায়, তৃণমূল ১১টি ও সিপিএম পাঁচটি আসন পেয়েছে। এ বার পুরপ্রধান হওয়ার দৌড় শুরু হয় মল্লিকাদেবী ও নিত্যানন্দবাবুর। তৃণমূল সূত্রের খবর, দু’জনেই নানা ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন, কিন্তু শিঁকে ছিড়বে না বুঝতে পেরে ফের ‘জুটি’ বেঁধে চঞ্চলবাবুকে পুরপ্রধান হওয়া থেকে আটকাতে মাঠে নেমে পড়েন। শেষমেশ ওই বছরের ২২ অক্টোবর গুসকরা পুরসভার পুরপ্রধান ও উপপুরপ্রধানের নাম বন্ধ খামে নিয়ে আসেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক। জানা যায়, ওই খামে পুরপ্রধান ও উপপুরপ্রধান হিসাবে নাম ছিল গীতারানি ঘোষ ও বুর্ধেন্দু রায়ের। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হননি তাঁদের কেউই। দলেরই একাংশের দাবি, মল্লিকা-নিত্যানন্দ জুটিই আটকে দিয়েছিল গীতারানি ও চঞ্চলবাবুকে। পরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নিত্যানন্দবাবুর অনুগামীরা পুরপ্রধান হিসেবে বুর্ধেন্দু রায়ের নাম প্রস্তাব করেন। ৪ নভেম্বর দলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় গুসকরায় হাজির থেকে কাউন্সিলরদের হুইপ জারি করে বুর্ধেন্দু রায়কে পুরপ্রধান ঘোষণা করেন।
গোড়ার দিকে তেমন গোলমাল ছিল না। তৃণমূল সূত্রের খবর, ওই জুটির সঙ্গে তাল মিলিয়েই পুরসভা চালাচ্ছিলেন বুর্ধেন্দু। কিন্তু বছর খানেক আগে নিত্যানন্দবাবুর সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। পুরসভার একটি গাড়ি কেনা নিয়ে তৈরি হয় দূরত্ব। তারপর একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে। পুরসভার অন্দরে নতুন ‘জুটি’ হন বুর্ধেন্দু ও মল্লিকাদেবী। তাঁরা দু’জনেই দলের পর্যবেক্ষক অনুব্রতবাবুর অনুগামী বলে পরিচিত। এর মধ্যেই কয়েক মাস আগে নিত্যানন্দবাবুর ‘অনুগামী’ রাখী মাজিকে উপপুরপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয় বুর্ধেন্দুবাবু। আগুনে ঘি পড়ে। শুরু হয়ে যায় চুলোচুলি, মারধর, বৈঠক ভেস্তে দেওয়া, তলবি সভা ডেকে পুরপ্রধানকে সরানোর গল্প।
বুর্ধেন্দুকে সরাতে হাত ধরেন এক সময়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চঞ্চল গড়াই ও নিত্যানন্দবাবু। পুরসভার মধ্যেও নিত্যানন্দবাবু ও মল্লিকাদেবীর মারামারির ঘটনা ঘটে। দু’পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে থানায় মারধর, শ্লীলতাহানির অভিযোগও দায়ের করেন। ৫ এপ্রিল পুরপ্রধানকে সরাতে চেয়ে তৃণমূলের পাঁচ কাউন্সিলর তলবি সভাতেও মত দেন। পরে অবশ্য সেই সভা বাতিলের নির্দেশ দিয়ে সোমবার ফের তলবি সভা ডাকার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। সেই মতো বুর্ধেন্দু-বিরোধী ছয় কাউন্সিলর (নিত্যানন্দ ও চঞ্চলের তিন জন করে অনুগামী) তলবি সভা ডাকেন। রবিবার আউশগ্রামের তৃণমূলের সদ্য বিধায়ক অভেদানন্দ থান্ডার বলেছিলেন, “ভোটাভুটি বা অনাস্থা না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুনবে কি না জানি না।” বিধায়কের আশঙ্কা সত্যি করে ছয় কাউন্সিলরই সোমবার অনাস্থা-বৈঠকে হাজির ছিলেন। সভা শুরুর আগেই পুরসভার পিছনে বোম পড়ে, পুরসভার সামনে লাঠি, বাঁশ হাতে পুরপ্রধান ও মল্লিকাদেবীর নামে হুমকি দেওয়া হয়। অভিযোগ, নিত্যানন্দবাবু ও তাঁর অনুগামীদের মহকুমাশাসকের সামনেই মারধর করা হয়। তারপরেও ছয় কাউন্সিলরই বুর্ধেন্দু রায়কে পুরপ্রধানের পদ থেকে সরানোর পক্ষে মত দেন। বুর্ধেন্দুবাবুরা আবার তাদের দুই কাউন্সিলরকে অপহরণ করা হয়েছে বলেও পাল্টা অভিযোগ করেন। মঙ্গলবার নিত্যানন্দবাবু জানান, অপহরণের বিষয়টিতে সিআইডি তদন্ত চেয়ে জেলাশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার ও মহকুমাশাসকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। অপহরণ আদৌ হয়েছিল কি না, তা জানতে হাইকোর্টে মামলা করা হবে বলেও তাঁর দাবি।
নিত্যানন্দবাবু বলেন, “চঞ্চলবাবুকে পুরপ্রধান হিসাবে না মেনে ঐতিহাসিক ভুল করেছিলাম। সেই ভুলের সংশোধন করে চঞ্চলবাবুকেই ফের পুরপ্রধান পদে মনোনীত করা হবে।” যদিও এখনই হার মানতে চান না মল্লিকাদেবীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা ন্যায়ের পক্ষে। ম্যাচ এখনও চলবে। স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে হবে।” আবার কোনও সমস্যা নেই বলেই দাবি করেছেন বীরভূমের জেলা সভাপতি তথা তৃণমূলের কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, আউশগ্রামের পর্যবেক্ষক অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘পুরপ্রধান এখনও নির্বাচন হয়নি। সব ঠিক আছে।’’ তবে গোলমালে তাঁর অঙ্গুলিহেলন রয়েছে বলেও দলের অনেকের মত। বীরভূমের এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘সবই দাদার খেলা।’’
আর শহরের বাসিন্দাদের প্রশ্ন, এর শেষ কবে?