তখন মাঝেমধ্যে যাতায়াত ছিল তাঁর। ফাইল চিত্র
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় তাঁর কেন্দ্র ছিল কাটোয়ার কাশীরাম দাস বিদ্যায়তন (কেডিআই)। কাটোয়ায় জেলা কংগ্রেসের এক অনুষ্ঠানে এসে নিজেই সে কথায় জানিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাই দেড়শো বছরের পুরনো স্কুলে ভগ্ন ছাত্রাবাস দেখে নতুন ছাত্রাবাস তৈরির জন্য সেই সময়ে তাঁর রাজ্যসভার সাংসদ তহবিল থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদানও দিয়েছিলেন তিনি।
সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির এমন নানা স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলার সঙ্গে। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা জানাচ্ছেন, বাংলা কংগ্রেসের সময় থেকে বর্ধমান শহরে তাঁর যাতায়াত। বাঁকা নদীর ধারে বাংলা কংগ্রেসের এক চিলতে ঘরে মাদুরে শুতেন। আবার বিসি রোডে বাংলা কংগ্রেসের অফিসের দোতলায় তক্তপোশে বসে গল্পও জুড়ে দিতেন।
বছর বিরাশির সৈয়দ ইমতাজ আলি ওরফে বাবু মিঞার কথায়, ‘‘আমরা তাঁর কাছে গল্প শুনতে যেতাম। সেই থেকে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার ছেলের বিয়েতেও এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও তিনি আমাদের ভোলেননি।’’ কংগ্রেস নেতা সাধন ঘোষের মৃত্যুর পরে, তাঁর স্মরণসভায় বর্ধমানের তেলমারুইপাড়ার বাড়িতে এসেছিলেন প্রণববাবু। সাধনবাবুর বাড়ির বসার ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে প্রণববাবুর নানা ছবি, তাঁর দেওয়া উপহার।
সাধনবাবুর স্ত্রী লেখাদেবী বলেন, ‘‘পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরেও তা ছিন্ন হয়নি। আমাকে বোনের মতো স্নেহ করতেন প্রণববাবু ও তাঁর স্ত্রী। মেয়ের বিয়েতে এসেছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি ভবনেও ঘুরে এসেছি।’’ তিনি জানান, ছ্যাঁচড়া, শুক্তো, আলু পোস্ত, মাছ খেতে ভালবাসতেন প্রণববাবু। রান্না করে বেশ কয়েকবার খাইয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘চপ-মুড়ি খেতেও ভালবাসতেন।’’
কংগ্রেসের জেলা সভাপতি প্রবীণ আভাস ভট্টাচার্যের বাড়িতেও এসেছিলেন প্রণববাবু। আভাসবাবুর কথায়, ‘‘কীর্ণাহারে আমার মেজদিদির শ্বশুরবাড়ি। সেই সূত্রে আলাপ। ১৯৯৬ সালে বর্ধমানের মোহনবাগান মাঠে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও এবং প্রণববাবু সভা করতে এসেছিলেন। ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায়। প্রণববাবু আমাকে গরম জলের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন।’’ তাঁর ছেলে সম্রাট বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। ২০০৭ সালে বর্ধমান পুর-উৎসবের উদ্বোধনে এসেছিলেন। বীরভূম যাওয়ার পথে বর্ধমানে বিশ্রাম নিতেন।’’ রেলকর্মী, কাটোয়া শহরের বাসিন্দা অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমার শিক্ষক অজিত চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে প্রণববাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ওঁর কথা শোনার জন্য বারবার কলকাতা ও মিরিটির বাড়িতে ছুটে গিয়েছি। অজস্র চিঠি লিখেছি, সে সবের উত্তরও পেতাম। রাজনৈতিক বিতর্ক করেছি। প্রশ্রয় দিতেন।’’
বর্ধমানের বাসিন্দা মহম্মদ আশরাফুল হকের কথায়, ‘‘আমি তখন অসমের বরপেটার কংগ্রেস সাংসদের ব্যক্তিগত সচিব। প্রণববাবু অসমে প্রচারে এসেছিলেন। তাঁকে নিতে দামি গাড়ি হাজির। উনি বিমানবন্দর থেকে আমার কাছে থাকা সাধারণ গাড়িতে উঠলেন। প্রচারের ক’টা দিন দেখেছি, এক দিকে বিদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, পরক্ষণেই কংগ্রেসের নীতি নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে চালক, রক্ষীদের খোঁজ নিচ্ছেন।’’
নানা স্মৃতি ভিড় করছে কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মনেও। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘১৯৮০ সালে প্রণববাবু বোলপুরে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। মঙ্গলকোট-কেতুগ্রাম ওই কেন্দ্রের অধীনে। সে জন্য উনি কেডিআই-তে গণনাকেন্দ্রে এসেছিলেন। তখনই দিল্লি থেকে ফোন আসে, ইন্দিরা গাঁধী দ্রুত ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। উনি তখন বললেন, ‘হেরেই তো যাচ্ছি, দিল্লি ফিরে কী হবে’! পরে দেখি, উনি বাণিজ্যমন্ত্রী। আসলে, জেতা-হারা দিয়ে প্রণববাবুর বিচার হয় না, উনি নিজেই নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।’’ তিনি জানান, শহরের জলপ্রকল্প আটকে গিয়েছিল। প্রণববাবুর হস্তক্ষপে তা চালু করা গিয়েছিল। নর্দমা তৈরি থেকে বিভিন্ন স্কুলকে সাহায্য, হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি তিনি।