চিন্তায় আলু চাষিরা। — ফাইল চিত্র।
মাঠ থেকে আলু তুলে লাভজনক দর মিলছে না, কয়েক দিন ধরেই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন চাষিদের একাংশ। কালনার বেগপুর পঞ্চায়েতের রাজখাঁড়া গ্রামে ইসমাইল শেখ (৫৫) নামে এক আলু চাষির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে সে দাবি তুলেছে তাঁর পরিবারও। পরিজনদের অভিযোগ, বছর তিনেক ধরে আলু চাষ করে লাভ মিলছিল না। ফলে, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। এ বারও আলুর দর শুনে ওই চাষি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। সোমবার সন্ধ্যায় এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। পূর্ব বর্ধমানের আলু চাষিদের অনেকেরই দাবি, একে আলুর লাভজনক দর নেই। তার উপরে, অনেকে প্রত্যাশার থেকে কম ফলন পাচ্ছেন। তাই তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে।
রাজ্যে অন্যতম ভাল আলু উৎপাদক জেলা পূর্ব বর্ধমানে আলু চাষ হয় প্রায় ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে। বেশির ভাগ চাষি জমিতে জ্যোতি আলু চাষ করেন চাষিরা। কৃষি দফতরের হিসাবে, এ বার আলু চাষ হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে। বেশ কয়েক বছর পরে এ বার আলু চাষের গোটা মরসুম জুড়ে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেনি। ঠান্ডা ও ঝলমলে আবহাওয়ায় আলু গাছে বিশেষ রোগপোকাও দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকের থেকে ফলন বাড়বে বলে চাষিদের অনেকেই আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের একাংশের দাবি, প্রত্যাশা মতো মেলেনি ফলন। বিঘা প্রতি জমিতে ফলন মেলে ৮০-১০০ বস্তা। কালনা, মেমারি, জামালপুরের মতো কিছু এলাকায় ফলন পৌঁছে যায় ১১৫-১২০ বস্তাতেও। এ বার সেখানে কোথাও ৬০-৬৫ বস্তা, আবার কোথাও ৮০-৯০ বস্তা ফলন মিলছে বলে অভিযোগ।
কালনা ২ ব্লকের তেহাট্টা গ্রামের চাষি জয়ন্ত বিশ্বাসের কথায়, ‘‘১০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। বিঘা প্রতি জমিতে ৬০ বস্তা করে ফলন মিলছে। এ বার আবহাওয়া ভাল থাকা সত্ত্বেও এতটা ফলন কমবে, আশা করিনি।’’ বাজিতপুর গ্রামের সাদ্দাম হকের দাবি, ‘‘বিঘা ছয়েক জমিতে আলু চাষ করেছি। ফলন মিলছে প্রতি বিঘায় ৫০ বস্তার কাছাকাছি।’’ মেমারির বড়া গ্রামের চাষি অরুণ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘যে সমস্ত জমিতে চাষিরা গত বছরের জমির আলু বীজ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, সেখানে বিঘা প্রতি জমিতে ফলন মিলছে ৬৫ বস্তার মধ্যে। আর যাঁরা পঞ্জাবের বীজে চাষ করেছেন, তাঁদের ফলন ৯০-১০০ বস্তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে। জমি থেকে আলু তোলার পরে অধিকাংশ চাষিকেই লোকসানের মুখেপড়তে হচ্ছে।’’
চাষিদের আরও অভিযোগ, চাষের জন্য সার, কীটনাশক, অণুখাদ্য-সহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। যাঁরা পঞ্জাবের বীজে চাষ করেছিলেন, তাঁদের বিঘা প্রতি জমিতে খরচ হয়েছে ৩৮ হাজার টাকার বেশি। জমির আলু বীজ হিসেবে যে চাষিরা ব্যবহার করেছেন, তাঁদের খরচ হয়েছে ২৫-২৮ হাজার টাকা। এখন বস্তা পিছু দর রয়েছে ৩৫০ টাকার মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে, চাষিদের বিঘা প্রতি জমিতে লোকসান হচ্ছে প্রায় ৮-১৫ হাজার টাকা।
‘প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি’র সদস্য আনন্দ সাঁতরার কথায়, ‘‘বহু চাষির ফলন কমেছে বলে শুনেছি। লাভজনকও দরও নেই। এই পরিস্থিতিতে অনেক চাষি হিমঘরে আলু মজুত রাখার রাস্তায় হাঁটছেন।’’ ফলন কমার কারণ কী? চাষিদের একাংশের ধারণা, গত বছর চাষ দুর্যোগের মুখে পড়েছিল। সময়ও মিলেছিল কম। ফলে, ওই আলুর বীজ থেকেও সমস্যা হতে পারে। আবার অনেকের মতে, গোটা মরসুম জুড়ে এক বারও বৃষ্টি না হওয়ায় ফলন কম হয়েছে। জেলার অন্যতম সহকারী কৃষি আধিকারিক পার্থ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘আমরা সব সময়ে চাষিদের শংসিত (সার্টিফায়েড) বীজ ব্যবহারের পরামর্শ দিই। বৃষ্টি না হওয়া নয়, বীজের কারণে ফলন কমতে পারে।’’ তিনি আরও জানান, এ বার অনেকটা সময় শীত ছিল ঠিকই, তবে মাঝেমধ্যে তেমন কড়া ঠান্ডা মেলেনি। এক সহকারী কৃষি অধিকর্তা সুকান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আলু তোলার পর্ব শুরু হয়েছে। ফলনের ঠিকঠাক চিত্র শীঘ্রইহাতে আসবে।’’