বিষাক্ত: কালো ধোঁয়ায় রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর শিল্পতালুকের আকাশের এমনই হাল। ছবি: বিকাশ মশান
গত বারের চেয়ে এ বারের শীতে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে দূষণ বেড়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে। পর্ষদের নজরদারির অভাবেই এই হাল, এমনই অভিযোগ শহরবাসীর একটা বড় অংশের।
শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দূষণ বৃদ্ধির অভিজ্ঞতা রয়েছে দুর্গাপুরবাসীর। কিন্তু এ বারের দূষণ গত বারের শীতের চেয়েও বেশি। পর্ষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ ও ২০১৯-র ৭ ডিসেম্বর রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর শিল্পতালুকে বাতাসের সার্বিক গুণমান সূচক (‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’) ছিল ১৩০ ও ১৫০। বেনাচিতিতে ২০১৮-র ৪ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর সেই মাত্রা যথাক্রমে ১৩১ ও ১৫১। কড়ঙ্গপাড়ায় ২০১৮-র ৫ ডিসেম্বর বাতাসের সার্বিক গুণমান সূচক ছিল ১২৯। ২০১৯-র ৬ ডিসেম্বর তা ছিল ১৪৯। পর্ষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একমাত্র বিধাননগরের পরিস্থিতি গত শীতের তুলনায় ভাল। সেখানে ২০১৮-র ২৯ ডিসেম্বর বাতাসের সার্বিক গুণমান সূচক ১৯৮। ২০১৯-র ২৮ নভেম্বর তা ছিল ১৫৮।
পর্ষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৪ থেকে বাতাসের গুণমান সহজবোধ্য করতে গুণমান সূচক নির্ধারণ শুরু হয়। বাতাসের গুণমান সূচক ০-৫০ হলে তা ভাল। ৫১ থেকে ১০০ ‘সন্তোষজনক’। এই পরিস্থিতিতে ‘অতিরিক্ত অনুভূতিপ্রবণ’ মানুষজনের সামান্য শ্বাসজনিত সমস্যা হতে পারে বলে চিকিৎসকেরা জানান। সূচক ১০১-২০০ হলে তা মাঝারি মানের। ফুসফুস, হৃদরোগী এবং বয়স্ক ও শিশুদের শ্বাসজনিত সমস্যা হতে পারে। শীত-সহ বছরভরই মাঝারি (মডারেট) মানের দূষণ থাকে শহর দুর্গাপুরে। এই পরিস্থিতি তাই অসুস্থদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের সুপার দেবব্রত দাস বলেন, ‘‘শীতে ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। দূষণ এর অন্যতম কারণ।’’
পর্ষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাতাসে পিএম ১০-এর (১০ মাইক্রোমিটারের ছোট আকারের ভাসমান ধূলিকণা) স্বাভাবিক পরিমাণ, গড় ১০০ মাইক্রোগ্রাম/ ঘনমিটার। সেই হিসেবে দুর্গাপুরের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা অনেক বেশি (এই শীতে ১৩৬.১৪ থেকে ১৭৫.৩৫)। তবে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ও সালফার ডাই অক্সাইডের হার কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্ধারিত মাত্রার নীচে।
কিন্তু বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বেশি কেন? পরিবেশকর্মীদের দাবি, এ বার উত্তুরে হাওয়ার গতিবেগ ও প্রাবল্য অন্য বারের চেয়ে বেশি। শহর জুড়ে নির্মাণ কাজ চলছে বছরভর। বর্ষার পরে অক্টোবর থেকে ‘রিয়েল এস্টেট’-এর নির্মাণকাজে গতি বাড়ে। ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ‘অসম্পূর্ণ’ সার্ভিস রোড, বহু জায়গায় ভাঙা সার্ভিস রোড দিয়ে গাড়ি চলায় ধুলো উড়ছে। পাশাপাশি, রাতুড়িয়া, অঙ্গদপুর, সগড়ভাঙায় রয়েছে কারখানার দূষণ রয়েছে। কারখানায় আসা-যাওয়া শত শত ট্রাক থেকেও দূষণ ছড়াচ্ছে। আবার বেনাচিতিতে মিনিবাস, বড়বাস, অটো, বাইক, গাড়ির ধোঁয়ায় দূষণ বাড়াচ্ছে। পর্ষদ সূত্রে জানা যায়, উত্তুরে হাওয়া, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমা, পশ্চিমি ঝঞ্ঝার ঘনঘন দিক পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণও। তুলনায় বিধাননগর এলাকায় কারখানা না থাকা, ট্রাকের যাতায়াত না থাকায় দূষণ কম।
তবে গত বারের চেয়ে এ বারের শীতে দূষণ বাড়ার পিছনে পর্ষদের নজরদারির অভাবকেও দায়ী করছেন অনেকে। পর্ষদের দুর্গাপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সেখান থেকে চারটি জেলার কাজকর্ম পরিচালিত হলেও ব্যাপক কর্মী-সঙ্কট রয়েছে সেখানে। পর্ষদের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘নিয়মিত সব জায়গায় অভিযান চালানোর পরিকাঠামো নেই। তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’ তিনি জানান, কিছু দিন আগে বাসিন্দাদের কাছে অভিযোগ পেয়ে সঞ্জীব সরণিতে একাধিক কারখানায় অভিযান চালিয়ে ‘স্যান্ড ব্লাস্টিং’ বন্ধ করা হয়েছে। দুর্গাপুর শহরের পাশে কাঁকসা ও দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকে ধানজমিতে নাড়া পোড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। এর জেরেও বাতাসে দূষণের হার বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। পর্ষদের ওই আধিকারিক অবশ্য বলেন, ‘‘নাড়া পোড়ানো বন্ধ করতে নানা ভাবে চাষিদের সচেতন করার কাজ চলছে। তবে এ বছর কোনও অভিযোগ দফতরে আসেনি।’’