দুর্গাপুর ব্যারাজ। ছবি: বিকাশ মশান
পলি জমে গভীরতা কমে গিয়েছে ব্যারাজের। সংস্কারের দাবি দীর্ঘ দিনের। বেঙ্গালুরুর জল-সঙ্কটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সেই দাবি আরও জোরাল হয়। লোকসভা ভোটের মুখে যা নিয়ে ফের শুরু হয়েছে তরজা। কাজ না হওয়ায় বিজেপি রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছে। তৃণমূল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পাল্টা অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছে।
দুর্গাপুর শহরে পানীয় জলের মূল উৎস দামোদর। পলি সংস্কার না হওয়ায় ব্যারাজের জলধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে, অতীতে প্রতি বছর বর্ষায় দামোদরের বন্যায় বিপুল ক্ষতি হত নিম্ন দামোদরে। ১৯৪৩ সালের বন্যায় অবিভক্ত বর্ধমান, বাঁকুড়া ও হুগলির নিম্ন দামোদর এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ ভেসে যায়। তাই বন্যা রোধে সরকার পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি আমেরিকার ‘টেনেসি ভ্যালি অথরিটি’র (টিভিএ) অনুকরণে একটি সংস্থা গড়ার পরামর্শ দেয়। ১৯৪৪ সালে টিভিএ-র ইঞ্জিনিয়ার ডব্লিউ ভরডুইন বহুমুখী পরিকল্পনার পরামর্শ দেন। ১৯৪৮ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) গড়ে ওঠে। বরাকর নদের উপরে তিলাইয়া ও মাইথন, দামোদরে তেনুঘাট ও পাঞ্চেত, কোনার নদীর উপরে কোনার জলাধার গড়া হয়। ১৯৫৫ সালে ৬৯২ মিটার লম্বা ব্যারাজ তৈরি হয় দুর্গাপুরে। গেটের সংখ্যা ৩৪। দামোদর-বরাকর অববাহিকার প্রায় সাড়ে ১৯ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ব্যারাজের ক্যাচমেন্ট এলাকা।
এই ব্যারাজের জলতল ২১১.৫০ ফুট বজায় রাখতে হয়। ডিভিসি সূত্রে খবর, ভূমিক্ষয়ে পলি জমে ও ড্রেজিং না হওয়ায় ব্যারাজের জলধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। শুরুতে জলধারণ ক্ষমতা ছিল প্রায় সাড়ে ৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় জল কমিশনের সমীক্ষা থেকে জানা যায়, তা নেমে এসেছে প্রায় সাড়ে ৩ মিলিয়ন কিউবিক মিটারে।
কিন্তু পলি কে তুলবে তা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য কাজিয়া চলছেই। ২০১৩ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী হরিশ রাওয়াত বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের তৎকালীন সাংসদ সাইদুল হকের চিঠির উত্তরে জানিয়েছিলেন, রাজ্য সরকার পলি, বালি তোলার কাজ করবে। সহযোগিতা করবে কেন্দ্র। ২০১৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী দুর্গাপুরে এসে দাবি করেন, ঝাড়খণ্ড সরকার দামোদর সংস্কারে নির্দিষ্ট প্রস্তাব জমা দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও প্রস্তাব পাননি। যদিও রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কাছে এ বিষয়ে একাধিক চিঠি দিয়েছেন।
সম্প্রতি বর্ধমান-দুর্গাপুরের বিদায়ী সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া দাবি করেন, “বিশ্বব্যাঙ্কের প্রজেক্ট থেকে অনেক টাকা রাজ্য সরকার পেয়েছে। সেচ দফতরের কাছে আছে। এই কাজটা ওরাই করে। ড্রেজিং সবার আগে মাইথন জলাধারে হওয়া দরকার। পাঞ্চেত জলাধারেও একই অবস্থা।” তাঁর সংযোজন: “ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট হল রাজ্যের বিষয়। সে জন্য কেন্দ্র রাজ্যকে টাকা দেয়। জলসম্পদ উন্নয়ন দফতর থেকে রাজ্য টাকা পায়। বিশ্বব্যাঙ্ক প্রচুর টাকা দেয়। সেই টাকার যথার্থ ব্যবহার হলে পলির সঙ্কট থাকবে না।”
বিজেপির অন্যতম রাজ্য সম্পাদক লক্ষ্মণ ঘোড়ুইয়ের দাবি, জলাধার সংস্কারে রাজ্য উদ্যোগী হয়নি। তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি উত্তম মুখোপাধ্যায়ের পাল্টা, “ব্যারাজ নিয়ে কেন্দ্র হাত গুটিয়ে বসে আছে। তাই কেন্দ্রের ভরসায় না থেকে মুখ্যমন্ত্রী ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে লকগেটের আমূল সংস্কার করিয়েছেন।” সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ রায় সরকার বলেন, “জলাধার সংস্কারে কেন্দ্র ও রাজ্য দায় ঠেলতে ব্যস্ত।”
শহরবাসীর দাবি, এই কাজিয়ায় ইতি টেনে এ বার জলাধার সংস্কার করা হোক। তা না করলে শুধু জনজীবন বিপর্যস্ত হবে না। প্রভাব পড়বে শিল্প-কারখানা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও।