অর্পণবাবুর বাবা, প্রাক্তন বিধায়ক বামাপদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: শৈলেন সরকার
দিনের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। সুনসান শহর। তার মধ্যেই প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন অনেকে। তাল কেটে গেল হঠাৎই। পরপর গুলির আওয়াজে খানখান হয়ে গেল নৈঃশব্দ।
মাটিতে মুথ থুবড়ে পড়েছিলেন বছর পঞ্চাশের অর্পণ মুখোপাধ্যায়। পিচ রাস্তা ভরে যাচ্ছিল তাজা রক্তে। পথচারীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের গতিতে দূরে মিলিয়ে যায় দু’টি মোটরবাইক। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন অনেকেই।
২০১২-র ১০ মে বার্নপুর ফুটবল স্টেডিয়াম রোডে দুষ্কৃতীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন সিপিএমের হিরাপুর জোনাল কমিটির নেতা অর্পণবাবু। তাঁর বাবা বামাপদ মুখোপাধ্যায় এক সময়ে হিরাপুরের বিধায়ক ও আসানসোলের মেয়র ছিলেন। চার বছর কেটে গেলেও ছেলের খুনের ঘটনার কোনও কিনারা না হওয়ায় হতাশ ৯৪ বছরের বামাপদবাবু। পুলিশ এখনও অবধি আততায়ীদের ধরতে পারেনি। কী কারণে, কারা এই কাণ্ড ঘটিয়ে গেল, হদিসই পাননি তদন্তকারীরা।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি দিনের মতো সে দিন ভোরেও হাঁটতে বেরোন অর্পণবাবু। পৌনে ৬টা নাগাদ ইস্কোর বক্সিং স্টেডিয়াম লাগোয়া লনে মোটরবাইক রেখে সবে ফুটবল স্টেডিয়াম রোডে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায় দু’টি মোটরবাইক। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানান, মোট চার জন আরোহীর মধ্যে দু’জন আগ্নেয়াস্ত্র বের করে পরপর গুলি চালায়। অর্পণবাবুর বুক ফুঁড়ে যায় চারটি গুলি। মোটরবাইক আরোহীরা যেন হওয়ায় মিলিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের একেবারে কাছে ইস্কো হাসপাতাল। অর্পণবাবুকে তড়িঘড়ি সেখানে নিয়ে গেলে মৃত বলে জানানো হয়।
আসানসোলের এসবি গড়াই রোড এলাকায় অর্পণবাবুদের পুরনো বাড়ি। এখন সেখানে থাকেন তাঁর স্ত্রী ইন্দিরাদেবী ও বাবা বামাপদবাবু। এই শিল্পাঞ্চলে ষাটের দশকের শ্রমিক নেতা বামাপদবাবু ছিলেন আসানসোল পুরসভার প্রথম মেয়র। এখন বাড়িতে বসে বই পড়ে সময় কাটে তাঁর। ছেলের অকাল প্রয়াণের শোক ভুলতে পারেননি বৃদ্ধ। খুনের মামলা এখন হাইকোর্টের বিচারাধীন। তাই গোড়ায় এ নিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন না তিনি। পরে অবশ্য বলেন, ‘‘আমাদের দাবি মেনে তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে সিআইডি। হাইকোর্টের শুনানিতে বিচারকের কাছে তদন্তকারী অফিসারেরা দুষ্কৃতীদের খোঁজ মিলছে না বলে জানিয়েছেন। জানি না, সুবিচার পাব কি না!’’
ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বারবার গলা কেঁপে ওঠে ইন্দিরাদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘এলাকায় ওঁর কোনও শত্রু ছিল বলে তো কখনও শুনিনি। কেন খুন করা হল, এখনও আমাদের কাছে ধোঁয়াশা। ২০১৪-র মার্চে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও তো কিছু হল না।’’ তাঁদের একমাত্র ছেলে অর্কজ্যোতি এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছিল, দুস্কৃতীরা সম্ভবত ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছিল। খুনের আগে এলাকা ঘুরে সব সরেজমিনে দেখে গিয়েছিল তারা। কারণ, অর্পণবাবুর গতিবিধি তাদের নখদর্পণে ছিল বলেই মনে হয়েছে পুলিশের। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে পুলিশ কমিশনারেটের দফতরে বহু বার অবস্থান-বিক্ষোভ করেছে সিপিএম। শহর জুড়ে মিছিল-মিটিংও হয়েছে। পরিবার ও দলের তরফে সিবিআই তদন্ত চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তদন্তভার গিয়েছে সিআইডি-র হাতে। তদন্তকারি অফিসারেরা বহু বার বাড়িতে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। অর্পণবাবুর ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলেও নানা তথ্য নিয়েছেন। কিন্তু এখনও দুস্কৃতীরা অধরা।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য বংশগোপাল চৌধুরী বলেন, ‘‘তদন্তের শুরুতে প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন তদন্তের যা অগ্রগতি, তাতে আর ভরসা রাখতে পারছি না।’’ তবে এ ব্যাপারে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান তিনি। তাঁদের বিশ্বাস, এক দিন না এক দিন নিশ্চয় জানা যাবে, কারা কীসের জন্য খুন করে গেল।