পাইপ থাকলেও জল নেই, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে। নিজস্ব চিত্র
২০ বছর সিপিএমের দখলে। তৃণমূলের হাতে ১২ বছর। কিন্তু কোনও আমলেই পূর্ব বর্ধমানের গুসকরায় পানীয় জলের সমস্যা মেটেনি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের।
শহরের বড় অংশের মানুষের অভিযোগ, পুরসভা পাইপ লাইন বসিয়েছে, কিন্তু তাতে জল আসে না। আর যদিও বা জল মেলে, তা-ও সুতোর মতো। সব মিলিয়ে পানীয় জলের জন্য গরম পড়তে না পড়তেই কার্যত হাহাকার দেখা দিয়েছে গুসকরা শহরে। বাসিন্দাদের এই ক্ষোভকেই পুরভোটের অস্ত্র করতে চাইছেন বিরোধীরা।
২০০৩ সালে কেন্দ্র সরকারের ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন’ কর্মসূচিতে পানীয় জল প্রকল্পের জন্যে আট কোটি টাকা পেয়েছিল গুসকরা পুরসভা। ঠিক হয়, ওই প্রকল্প থেকে বাড়ি বাড়ি জল দেওয়া হবে। তার আগে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের একটি উচ্চ জলাধার আর দু’টি সাবমার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে শহরের ২৩৪টি বাড়িতে জল দেওয়া হতো। তারও আগে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পুর এলাকায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহের কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলেই জানা যায়।
পুরসভা সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে পাইপ লাইনে জল সরবরাহ শুরু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে ৭৮৭টি বাড়িতে জল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয়। ১১টি ওয়ার্ডে পাইপ লাইন বসে। বর্তমানে গুসকরা শহরে চারটে উচ্চ জলাধার ও চারটে সাবমার্সিবল থেকে প্রায় ২,৬০০ বাড়িতে জলে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও রাস্তায় জলের সংযোগ রয়েছে।
কিন্তু ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের দাবি, সংযোগ থাকলেও কোথাও তিন মাস, কোথাও দু’বছর পর্যন্ত জলের ‘দেখা নেই’। এমনকি, পুর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেও সুরাহা হয় না। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে, মহিলা স্কুলের কাছে বসবাসকারী কল্যাণ দাস, আট নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বাশা পল্লির বাসিন্দা বিউটি পালদের দাবি, “তিন বার জল দেওয়ার কথা। সকালের দিকে আধ ঘণ্টার জন্য সরু হয়ে জল পড়ে। এক বালতি জল ভরতে না ভরতে জল চলে যাওয়ার উপক্রম হয়।’’ ১১ নম্বর ওয়ার্ডের তারাপদ গড়াইয়ের অভিযোগ, “দু’বছর আগে পুরবোর্ডের বৈঠকের পরে, আমাকে জলের সংযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পাইপ লাইন দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়েনি। কী যে হচ্ছে!’’ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মনুজেন্দ্র ঘোষ আবার বলেন, ‘‘জল আসে খেয়ালখুশি মতো। গত তিন মাস ধরে জলের দেখা পাইনি। পুরসভায় গিয়ে বলে এলে পরের দিন আধ ঘণ্টার জন্য জল মেলে।’’ আবার রাস্তার কলে জল পাওয়া গেলেও তা পান করার অযোগ্য বলে জানান শহরের বেশির ভাগ ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁদের দাবি, জল দিয়ে শ্যাওলা থেকে নানা রকমের নোংরা বার হয়।
তবে শহরের মধ্যে জলসঙ্কট থাকলেও, কুনুর নদী পাড় হয়ে ধরমপুর, কেলেটি, কমলনগর এলাকায় গেলে দেখা যায়, পানীয় জল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ‘গুসকরা নাগরিক সুরক্ষা সমিতি’র কর্ণধার তপন মাজির কথায়, “কোথায়, কতটা জলের প্রয়োজন সে হিসেব না করেই রাজনৈতিক স্বার্থে সাবমার্সিবল বসানো হয়েছে। আবার ধরমপুর, পুননগর, কেলেটি, কমলনগর এলাকায় বাড়ি-বাড়ি পানীয় জল দেওয়ার জন্য পুরসভায় আবেদন করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অথচ, সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সে কারণেই জল অপচয় হচ্ছে।’’
গুসকরার প্রাক্তন পুরপ্রধান, সিপিএমের বিনোদ চৌধুরীর দাবি, “কেন্দ্রের ওই প্রকল্পের মাধ্যমে শহরে পানীয় জলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে আগামী ২৫ বছরের জন্য মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে আমরা চলে যাওয়ার পরে, ক্ষমতার চেয়ে বেশি পাইপলাইন বসিয়ে বাড়ি বাড়ি জল দেওয়া হচ্ছে। অথচ, জল কী ভাবে মিলবে, তার হদিস করা হয়নি।’’ তৃণমূলের প্রথম পুরপ্রধান, বর্তমানে বিজেপি নেতা চঞ্চল গড়াইয়েরও অভিযোগ, “শাসক দলের রাজনৈতিক ক্ষমতানুসারে জলের বিন্যাস ঘটানো হয়েছে। সে কারণে একদিকে জলের হাহাকার, অন্য দিকে জল উপচে নষ্ট হচ্ছে।’’ পুরভোটের প্রচারে মানুষকে এ সব জানানো হবে বলেও দাবি
করেছেন তাঁরা।
জলের সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন বিদায়ী পুরপ্রধান বুর্ধেন্দু রায় ও বিদায়ী কাউন্সিলর নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের দাবি, “এই ক’বছরে অনেকটা সমস্যা মেটানো গিয়েছে। আরও পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু দেড় বছর ধরে পুরবোর্ড না থাকায় নজরদারির অভাব রয়েছে।’’
পুরসভার আধিকারিকদের একাংশ দাবি করেছেন, ক্ষমতার চেয়ে সংযোগ বেশ কিছু জায়গায় বেশি হওয়ায় জলবণ্টনে সমস্যা হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাস্তা তৈরি ও মাটির নীচে বিদ্যুৎ দফতরের কেবল বসাতে গিয়ে পাইপ লাইন ফেটে যাওয়ায় বর্তমানে সমস্যা আরও বাড়ছে। পুরসভায় জলের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক সুকান্ত সামন্ত বলেন, “জলের সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছি।’’