মোবাইলে চোখ ধুনুরির। কাটোয়ায়। নিজস্ব চিত্র
লেপমুড়ি দিয়ে শীতের আমেজ নেওয়া, বাঙালির চিরকালের অভ্যাস। কিন্তু সেই অভ্যাসেই বোধহয় খানিক বদল এসেছে। অন্তত তেমনটাই মত বহু বছর ধরে কাটোয়ায় শীতের মরসুমে আসা ভিন্-রাজ্যের ধুনুরিদের। লেপের জায়গা কাড়ছে কম্বল, দাবি শহরের লেপ ব্যবসায়ীদেরও।
কাটোয়া শহরে প্রায় ২০টি লেপের দোকান রয়েছে। বছর পাঁচেক আগেও শীত পড়তেই বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড থেকে দল বেঁধে ধুনুরিরা শহরে আসতেন। দোকান থেকে বরাত নিয়ে ডাঁই করা তুলো পিটিয়ে তৈরি করতেন একের পর এক লেপ। মরসুম শেষে মোটা টাকা মজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা। কিন্তু, বছর তিনেক ধরে বাজার মন্দা হওয়ায় ধুনুরিদের আসা অনেকেটাই কমেছে, দাবি লেপ ব্যবসায়ী আব্দুল রাকিব, মোশা শেখ, নাসিমুদ্দিন শেখদের। তাঁরা জানান, একটা সময় শহরে ৫০ থেকে ৬০ জন ধুনুরি আসতেন। এখন সেটা মেরেকেটে ২০ জন।
এ বার বিহার থেকে কাটোয়ায় এসেছেন ধুনুরি মহম্মদ জসিম, রকি শেখ, মিলন শেখদের মতো কয়েকজন ধুনুরি। তাঁরা বলেন, ‘‘প্রায় ২৫ বছর ধরে আমরা কাটোয়ায় আসছি। কিন্তু, এ বছর যা পরিস্থিতি, হাতে কাজই প্রায় নেই। চার-পাঁচটা দোকানের হয়ে কাজ করছি। তবুও দিনে এক-দু’টোর বেশি লেপ তৈরির বরাত নেই। এক-দু’শো টাকা আয় হচ্ছে।’’— রকি, মিলনেরা যখন এ কথা বলছেন, তখন অন্য ধুনুরিরা বসেই। তাঁরা জানান, আগে দিনে প্রায় পাঁচশো টাকা পর্যন্ত রোজগার হত। এ বার কাজই পাননি তেমন ভাবে।
কিন্তু কেন এই হাল? শহরের শাঁখারিপট্টিপাড়ার মহিলা সুপ্রিয়া সাহা হাজরা বলেন, ‘‘শীতে কম্বলই বেশি ব্যবহার করি। দেখতে সুন্দর। ওজনেও হালকা। শীত মিটলেই ‘ড্রাইওয়াশ’ করে সহজে ভাঁজ করে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখা যায়। এ সব লেপের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।’’ তবে দরের দিক থেকে কম্বল ও নতুন লেপ প্রায় একই, হাজার থেকে ১,২০০ টাকা। তবে ‘ব্র্যান্ড’ অনুযায়ী কম্বলের দামের ওঠানামা আছে।
এই পরিস্থিতিতেই প্রশ্ন, বাঙালির লেপ-অভ্যাস কি তা হলে পরিবর্তনের মুখে? বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতিতে কিন্তু এটির ব্যবহার বহুল। ভাষাতাত্ত্বিকেরা জানান, ‘লেপ’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘লিহা’ফ’ শব্দ থেকে। ‘আত্মপরিচয়’-এ ‘বাল্যবয়সে’ শীতের সকালে লেপ ফেলে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ও শীতের দিনে ‘সকালে লেপ থেকে বেরোতে’ ভাবনা হয় রবি ঠাকুরের! আবার অনেক পরে কবীর সুমনের বিখ্যাত গান ‘তোমাকে চাই’-এও লগ্ন থাকে ‘লেপের আদর’। এ সব দেখেই বোধহয় বাঙালির মনে পড়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথা— ‘লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার মতো মিষ্টি কিছু নেই...।’ (‘বিনুর বই’, প্রথম পর্ব)
এই ‘ঐতিহ্যের’ দিকে তাকিয়েই বোধহয় কাটোয়ার মাধবীতলার বৃদ্ধা সন্ধ্যা সরকারের ‘ভোট’ লেপের দিকে। তাঁর কথায়, ‘‘শীতকে জব্দ করতে লেপের জুড়ি নেই। তা ছাড়া, লেপ আর্থিক সাশ্রয়ও করে। কাপড় পাল্টে দিলে বা সামান্য পরিমাণে নতুন তুলো দিলেই পুরনো লেপ ফের ব্যবহারকরা যায়।’’
তবে পরিস্থিতির বিচারে কিন্তু বাজারে আপাতত এগিয়ে কম্বলই। আর তাই, লেপ ব্যবসায়ী মোশা বা ধুনুরি রকিদের আশঙ্কা, ‘‘এমনটা চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম হয়তো ধুনুরির পেশাতেই আসবে না।’’