সুনসান। দুর্গাপুরের স্টেশন লাগোয়া এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
গলদঘর্ম হয়ে টেবিল ফ্যান বগলদাবা করে রিকশায় উঠছিলেন দুর্গাপুরের ডিএসপি টাউনশিপের বাসব দাঁ। বললেন, ‘‘মাথার উপরে ফ্যান ঘুরলেও স্বস্তি নেই। বাধ্য হয়ে এই ব্যবস্থা।’’
দৃশ্য ২: শনিবার বিকেলে আসানসোলের বড় বাজারে পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। কিন্তু বাজার সুনসান। জামাইষষ্ঠীর আগের দিন এমন পরিস্থিতি দেখে কার্যত মাথায় হাত তাঁদের।
প্রচণ্ড গরমে গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়ে এমন দৃশ্যের ছড়াছড়ি। বেলা খানিকটা গড়াতে না গড়াতেই রাস্তাঘাট সব সুনসান। দুর্গাপুর সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ড, ভগৎ সিংহ মোড়, বেনাচিতি বাজার থেকে আসানসোলের এসবি গড়াই রোড— সবই যেন গড়ের মাঠ। যে দু’এক জন রাস্তায় বেরোচ্ছেন, তাপ থেকে রেহাই পেতে আপাদমস্তক ঢেকে নিচ্ছেন সবাই। মানুষজন বাইরে না বেরোনোয় বেচাকেনা কমেছে দোকান-বাজারে। তবে বাতানুকূল যন্ত্র ও পাখা বিক্রি হচ্ছে হুড়মুড় করে।
রবিবার সন্ধ্যায় ঝড়-বৃষ্টির পর। বর্ধমানের কাছারি রোডে উদিত সিংহের তোলা ছবি।
রবিবার সন্ধ্যায় জেলার গ্রামীণ এলাকায় অবশ্য খানিকটা ঝড়-বৃষ্টি হয়। বজ্রপাতের জেরে বর্ধমান ও তালিতের মাঝে বিদ্যুতের লাইনে সমস্যা হওয়ায় প্রায় ৪৫ মিনিট ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়। শিল্পাঞ্চলের আকাশে বিকেল থেকে খানিকটা মেঘ উঁকি দিলেও বৃষ্টি নামেনি।
গরমের সঙ্গে মোকাবিলায় দুর্গাপুর ও আসানসোল—দুই শহরেই বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। দুর্গাপুর মহকুমা স্বাস্থ্য দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, গরমে অসুস্থ হয়ে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের সুপার দেবব্রত দাস বলেন, ‘‘পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি বিভাগেই গরমে কাহিল রোগীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ওআরএস, স্যালাইন ও অক্সিজেন মজুত রাখা হয়েছে।’’ এ ছাড়া গরমের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে লিফলেট ছাপিয়ে বিলির উদ্যোগও হয়েছে বলে জানান দেবব্রতবাবু। গরমের মধ্যে ভিড় জমছে রাস্তার পাশে রকমারি রঙিন পানীয় বিক্রির দোকানে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ওই পানীয় মোটেই স্বাস্থ্যকর নেয়।
প্রচণ্ড গরমে সুনসান কালনা স্টেশন। রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টায়।
সন্ধ্যায় অবশ্য খানিকটা ঝড়-বৃষ্টি হল। মধুমিতা মজুমদারের তোলা ছবি।
এমনিতে গরম পড়তেই দুর্গাপুরের কিছু কিছু জায়গায় পানীয় জলের আকাল দেখা দিয়েছিল। এই ক’দিনে তা আরও বেড়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সব এলাকায় জল পাঠানোর জন্য অতিরিক্ত ট্যাঙ্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহকুমাশাসক জানান, স্কুলগুলিতে ছুটি পড়ে গিয়েছে। আদালত বসছে সকালে। এর ফলে কিছুটা রেহাই মিলেছে। আগামি সপ্তাহে প্রশাসনিক বৈঠক হবে। তিনি বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট সব দফতর ও বিভাগকে নিয়ে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
আসানসোলের জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবাশিস হালদার জানান, এই পরিস্থিতিতে ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের নিয়ে তিনি জরুরি বৈঠক করে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘ব্লকের সব ক’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওআরএস এবং স্যালাইন মজুত রাখা হয়েছে। বাসিন্দারা চাইলেই তা পাবেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সারাক্ষণ চিকিৎসক রাখার কথা বলা হয়েছে।’’ গরমে কী ভাবে সুস্থ থাকতে হবে, সে ব্যাপারে প্রচার অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, বাইরে বেরোলে সুতির পোশাক পরা উচিত। প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে। মাঝে-মাঝে নুন-চিনির জল খাওয়া দরকার। সামান্য অসুস্থ বোধ করলেই কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
স্বস্তির খোঁজে। —নিজস্ব চিত্র।
আসানসোল জেলা হাসপাতালের সুপার নিখিলচন্দ্র দাস জানান, তাঁরাও পর্যাপ্ত ওআরএস এবং স্যালাইন মজুত রেখেছেন। নানা ভাবে অসুস্থ হয়ে জনা তিরিশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে। নিখিলবাবু জানান, হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটটি তৈরি হওয়ার পরে গরমে হঠাৎ অসুস্থ পড়া মানুষজনের চিকিৎসায় সুবিধা হয়েছে। আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস জানান, শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় পানীয় জলের সরবরাহ ঠিক রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে।
গরমের হাত থেকে বাঁচতে নানা পন্থা নিচ্ছেন বাসিন্দারা। দুর্গাপুরের ডিএসপি টাউনশিপের প্রবীণ বাসিন্দা রামপ্রকাশ সিংহ জানান, রাস্তায় বেরোনোর আগে ছাঁচি পেঁয়াজ খেয়ে বেরোনো দরকার। তাহলে তাপ কম অনুভব হবে। আরও ভাল হয় মুখের মধ্যে লজেন্সের মতো ছাঁচি পেঁয়াজ রেখে রাস্তায় হাঁটাচলা করলে। তাঁর কথায়, ‘‘এখন তো গাড়ি-ঘোড়ার চল। আমাদের সময়ে হাঁটাচলা ছাড়া গতি ছিল না। বাবা-কাকারা এই ছাঁচি পেঁয়াজের দাওয়াই দিতেন। আমরা সে কথা মানতাম, ফলও পেতাম।’’