প্রতীকী ছবি।
গ্রামে-গ্রামে দালাল নিয়োগ করে চিকিৎসা, দৈনন্দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ‘টোপ’ দেওয়া। কোনও রকমে বুঝিয়ে তাঁদের নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া। তার পরে, ‘রোগীর’ বায়োমেট্রিক ছাপ নিয়ে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে ৬০-৭০ হাজার টাকার বিল। এই ‘ছকেই ’পূর্ব বর্ধমানের বিভিন্ন নার্সিংহোম স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের টাকা হাতানোর ফাঁদ পেতেছিল বলে তারা জানতে পেরেছে বলে দাবি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের।
রাজ্যের এক স্বাস্থ্য কর্তা বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘বর্ধমানের খোসবাগানের একটি নার্সিংহোমকে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প থেকে ওই নার্সিংহোমের পাওনা টাকা আটকে রাখারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলায় আরও কয়েকটি নার্সিংহোম সম্পর্কেও একই অভিযোগ এসেছে। নজরদারি দলকে আরও বেশি করে আচমকা পরিদর্শনের কথা বলা হয়েছে।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা তথা স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের নজরদারি দলের চেয়ারম্যান অজয় চক্রবর্তী ওই নার্সিংহোমকে সাসপেন্ড করার ও তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের টাকা আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিন জেলা পর্যায়েও স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের ‘অনিয়ম’ নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জেলাশাসক প্রিয়ঙ্কা সিংলা, অতিরিক্ত জেলাশাসক (স্বাস্থ্য) ইউনিস রিসিন ইসমাইল, সিএমওএইচ প্রণব রায়েরা উপস্থিত ছিলেন। খোসবাগানের একটি নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে ওঠা স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের জালিয়াতির অভিযোগ নিয়েও আলোচনা হয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর ও জেলা প্রশাসনের নির্দেশে স্বাস্থ্য দফতরের পাঁচ সদস্যের দল তদন্ত করেছে। প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট তারা জানিয়েছে, ‘বেআইনি ভাবে’ স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড আটকে রাখা হয়েছিল। ওই নার্সিংহোমে স্বাস্থ্যসাথীর জন্য আলাদা কোনও রেজিস্টার ছিল না। তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ, ১৫টি কার্ড কোনও দিনই ব্যবহৃত হয়নি। অথচ, সেগুলি নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। ৬২টি কার্ডে প্যাকেজ ‘ব্লক’ হলেও ৪৬টি কার্ডের জন্য কোনও ‘ডিসচার্জ সার্টিফিকেট’ নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেননি। জেলাশাসক বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে আমরা কঠোর অবস্থান নিতে চলেছি।’’
জেলার কাছ থেকে ওই রিপোর্ট পাওয়ার পরে রাজ্যের নজরদারি দলও প্রায় তিন মাসের স্বাস্থ্যসাথী পোর্টালে ‘আপলোড’ হওয়া নথি খতিয়ে দেখে। তাঁদেরও দাবি, একই কার্ডে অনেকগুলি প্যাকেজ ‘ব্লক’ করা হয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্টের নথিতে ‘অসঙ্গতিও’ রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের নিয়ম মেনে রোগীকে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ দেওয়া হয়নি। আবার এক দিন রোগী ভর্তি রেখে সাত দিনের শয্যা ভাড়া নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। তদন্তকারীদের দাবি, গ্রামের দালালের মাধ্যমে সুস্থদের ১০-১২ হাজার টাকার টোপ দিয়ে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিকিৎসার নামে কার্ডের সব টাকা চলে যাচ্ছে নার্সিংহোমের কাছে। এক-এক দিনে ১০-১২ জন রোগী একই এলাকা থেকে, একই রকম গা-ব্যথা, মাথা ব্যথা, বমি-বমি ভাব, ঘুম না-আসার মতো অনির্দিষ্ট উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন বলেও দেখেছেন তদন্তকারীরা। যা ‘অস্বাভাবিক’ ঠেকেছে, স্বাস্থ্য দফতরের কাছে। যদিও এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। ওই নার্সিংহোমের অন্যতম কর্তা আবির গুহ বলেন, ‘‘আমি এ সব নিয়ে কিছু বলব না। আমার কাছে কোনও খবর নেই।’’
জেলাশাসকের দফতরে এ দিনের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, অপ্রয়োজনে কোনও নার্সিংহোম বা বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড রাখবে না। জেলার নজরদারি দল আচমকা যে কোনও নার্সিংহোমে হানা দেবে এবং ‘বায়োমেট্রিক’ ছাপ না মিললে স্বাস্থ্যসাথী বিভাগ আর আবেদন গ্রাহ্য করবে না। প্রশাসনের কর্তারা মনে করছেন, বয়স্কদের ধরে এনে ছাপ মিলছে না বলে অনুমোদনের মধ্যেই জালিয়াতি লুকিয়ে রয়েছে।
জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, ‘‘আমাদের নজরে বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম ও বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। প্রতি মাসে নিয়ম করে ওই সব নার্সিংহোমে আচমকা হানা দেওয়া হবে।’’