সিপিএমের পথসভায় হামলার অভিযোগকে কেন্দ্র করে অশান্ত বর্ধমানের কালনা রেলগেট এলাকা। পুড়ছে সিপিএম কর্মীদের গাড়ি।
বিনিয়োগ নিয়ে শাসক দলের নেতার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক নেই— মনে করছেন শিল্পোদ্যোগীরাই। বর্ধমানের দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ বা বাঁকুড়ার বড়জোড়া, বিষ্ণুপুর— গত চার বছরে নতুন শিল্প গড়ে ওঠার খবর নেই। কিন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার সংখ্যা অগুণতি।
শুক্রবার দুর্গাপুরে বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগীদের নিয়ে আয়োজিত কর্মশালায় বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী আক্ষেপ করেন, ‘‘গত চার বছরে রাজ্যে সে ভাবে শিল্প আসেনি। সেটা আমাদের কাছে অত্যন্ত দুঃখের।’’ শাসক দলের নেতার হঠাৎ এমন ‘বোধোদয়’-এর কারণ কী, সে নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। তবে অরূপবাবুর মন্তব্যের সঙ্গে সহমত বিরোধী থেকে শিল্পোদ্যোগীদের নানা সংগঠনের কর্তারা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি নানা শিল্প সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ গতি পায়। গড়ে উঠতে শুরু করে ইস্পাত, ধাতব ও অনুসারী শিল্প কারখানাগুলি। ইস্পাত ছাড়াও স্পঞ্জ আয়রন, ফেরো অ্যালয়, পিগ আয়রণ, কারখানা গড়ে ওঠে। বর্ধমান জেলায় এমন প্রায় ১০৪টি কারখানা তৈরি হয়। রানিগঞ্জের মঙ্গলপুর, জামুড়িয়া, সালানপুর, দুর্গাপুরের রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর, খয়রাশোল, বাঁশকোপা, বামুনাড়া ইত্যাদি এলাকায় কারখানাগুলি গড়ে ওঠে। গত দু’তিন বছরে তার মধ্যে ২১টি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাঁচামাল হিসেবে লৌহ আকরিকের অভাব, বিদ্যুতের মাসুল বৃদ্ধি, বাজারের অভাব-সহ নানা কারণে বাকি কারখানাগুলি পূর্ণ ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।
দলের কর্মীদের সঙ্গে তৃণমূল কাউন্সিলর সৈয়দ মহম্মদ সেলিম (চিহ্নিত)।
বাঁকুড়া জেলায় এই ধরনের কারখানার সংখ্যা ছিল ৪২টি। মূলত বড়জোড়া ও বিষ্ণুপুরে সেগুলি গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে ১১টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারখানা মালিকদের নানা সংগঠনের কর্তারা বলেন, ‘‘আকরিকের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় ভিন্ রাজ্যের উপরে। রাজ্য সরকারের মধ্যস্থতা ছাড়া আকরিকের নিয়মিত জোগান পাওয়া অসম্ভব। গত কয়েক বছরে আকরিকের আকালে বহু কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। নতুন কারখানা খুলতে কেউ সাহস পাননি।’’
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে ইস্পাত অনুসারী শিল্প হিসেবে এক সময়ে রমরমা ছিল ক্ষুদ্র ইঞ্জিনিয়ারিং, ফেব্রিকেশন, রিফ্যাকট্রি শিল্পের। এই ধরনের কারখানার সংখ্যা ছিল শ’চারেক। সগড়ভাঙার আরআইপি শিল্পতালুক, জাকির হোসেন অ্যাভিনিউয়ের মতো কয়েকটি জায়গায় সেগুলি গড়ে উঠেছিল। দুর্গাপুর স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন তার মধ্যে শ’খানেক কারখানা কোনও রকমে টিকে রয়েছে। বাকিগুলি হয় উৎপাদন বন্ধ রেখেছে, অথবা একেবারেই ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। নতুন কোনও শিল্প সংস্থা খোলার খবর তাঁদের কাছে নেই বলে জানান সংগঠনের একাধিক কর্তা।
সিটুর জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্র কিশোর চক্রবর্তী এক সময়ে ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন। তাঁর দাবি, বাম আমলে বর্ধমান জেলায় গড়ে ওঠা লৌহ-ইস্পাত অনুসারী শিল্প এবং ধাতু শিল্পে প্রায় ৭০ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছিল। গত তিন-চার বছরে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে, কাজ হারিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বিনিয়োগ না আসায় ইস্পাত ও অনুসারী শিল্পে ভাটা পড়েছে। অন্য দিকে, গ্রামীণ অর্থনীতিও সঙ্কুচিত হয়েছে। ফলে সেখানেও বাজার কমে গিয়েছে।’’ তাঁর দাবি, সার্বিক অবস্থার কথা জানিয়ে শিল্প দফতরের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও জবাব পাননি।
ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পোন্নয়ন নিগম যদিও রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ না আসার কথা মানতে চায়নি। এ দিন দুর্গাপুরের আরবান হাটে কর্মশালার শেষে নিগমের ডিরেক্টর দেবীপ্রসাদ করণম জানান, এই কর্মশালায় ২৭৭টি জমি চরিত্র বদল ও মিউটেশন করা হয়েছে। যার মধ্যে বর্ধমানে রয়েছে ১৭১ ও বাঁকুড়ায় ১০৬টি। এই কর্মশালায় ২২০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। যার মধ্যে ১২ কোটি টাকা শিল্পোদ্যগীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নতুন শিল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে প্রায় ৯৩৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে শিল্পতালুক ও ক্লাস্টারে প্রায় ২০০ কোটি ও বিভিন্ন শিল্পতালুকে প্রায় ৭৩৮ কোটি টাকা। বর্ধমানে ৫২৩ কোটি ও বাঁকুড়ায় ২১৫ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে বলে জানান তিনি।
পরিস্থিতি সামলাতে আসরে পুলিশ।
যা শুনে দুর্গাপুর স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কৃপাল সিংহ বলেন, ‘‘প্রস্তাব এসেছে ঠিক আছে। কিন্তু তার বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’’ তিনি অভিযোগ করেন, দুর্গাপুরের আরআইপি শিল্পতালুকে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় জেরবার কারখানা মালিকেরা। সংগঠনের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত চিঠি দিয়েও লাভ হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘শ’খানেক কারখানা চলছে বটে। তবে বাজারের অভাব এবং অন্য নানা কারণে ভাল ভাবে চলছে মাত্র ৩০-৪০টি।’’ ওয়েস্ট বেঙ্গল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শঙ্করলাল অগ্রবাল জানান, গত দু’তিন বছরে নতুন ইউনিট তো দূর, পুরনোগুলি চালানোই মুশকিল হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি না পাল্টালে নতুন বিনিয়োগ আসা মুশকিল বলে তাঁর মত।
শনিবার বিকেলে ছবিগুলি তুলেছেন উদিত সিংহ।