পলকে উধাও হয়ে যায় মোটরবাইক, ‘মাস্টার কি’র জাদুই অস্ত্র

রানিগঞ্জের বাসিন্দাদের দাবি, গত দু’বছরে এই শহর থেকে শতাধিক মোটরবাইক চুরি গিয়েছে। যদিও রানিগঞ্জ থানার হিসেবে, শেষ চার মাসে মোটে ১২টি মোটরবাইক চুরি হয়েছে।

Advertisement

নীলোৎপল রায়চৌধুরী

রানিগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৭ ০১:২৭
Share:

চালক না থাকলেও এখান থেকে উধাও হয়ে যায় বাইক। রানিগঞ্জে এলআইসি অফিসের সামনে। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

দৃশ্য এক: স্থান, রানিগঞ্জের পঞ্জাবি মোড়। বাড়ির সামনেই মোটরবাইকটা দাঁড় করানো। হেলমেট মাথায় বাড়ি থেকে বেরোতে যাবেন, এমন সময় শিপ্রা গ্লোসারিয়া দেখলেন, মোটরবাইক উধাও!

Advertisement

দৃশ্য দুই: রানিগঞ্জের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা, তারবাংলা বাসস্টপের সামনেই গলি। সেখানেই থাকেন দীপক দে। দীর্ঘদিনের পরিচিত একটি সেলুনের সামনে মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। ঘড়ির কাঁটায় বড় জোর আধ ঘণ্টা পরে দীপকবাবু এসে দেখলেন মোটরবাইক হাওয়া।

— দু’টি ঘটনা চলতি বছরের অগস্ট মাসের। তবে একটা বা দু’টো নয়, রানিগঞ্জের বাসিন্দাদের দাবি, গত দু’বছরে এই শহর থেকে শতাধিক মোটরবাইক চুরি গিয়েছে। যদিও রানিগঞ্জ থানার হিসেবে, শেষ চার মাসে মোটে ১২টি মোটরবাইক চুরি হয়েছে।

Advertisement

পুলিশের এই হিসেবের সঙ্গে সহমত নন শহরের বাসিন্দারা। রানিগঞ্জের স্কুলপাড়ার সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বার্নপুরের রাধানগর রোডের বাসিন্দা সৌমেশ্বর বসু থেকে শুরু করে কর্মসূত্রে নিত্য রানিগঞ্জে আসা বাঁকুড়ার মেজিয়ার পার্থ নন্দী, —সকলেরই অভিযোগ, জুলাই-অগস্টে খোওয়া গিয়েছে তাঁদের মোটরবাইক। শহরের প্রবীণ চিকিৎসক সমরেন্দ্রকুমার বসুর দাবি, ‘‘গত আট মাসে আমার চেম্বারের সামনে থেকেই আমার পরিচিত দু’জনের মোটরবাইক চুরি গিয়েছে।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, মোটরবাইক চুরি হচ্ছে ‘মাস্টার কি’ দিয়ে। কামারের কাছ থেকে এই বিশেষ চাবি তৈরি করায় চোরেরা। বিভিন্ন সংস্থার মোটরবাইকের ‘লক’ খুলতে এই চাবি ব্যবহার করা হয়। আবার কিছু-কিছু দুষ্কৃতী দল নিজেদের কাছে বিভিন্ন সংস্থার মোটরবাইকের চাবি রাখে। সেগুলো প্রয়োজনমতো উকো ঘষে ব্যবহার করে।

কিন্তু চোরাই মোটরবাইক কী কাজে ব্যবহৃত হয়? বিক্রিই বা হয় কোথায়? স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধ খাদানের জল তুলে ফেলা, সেচের জল তোলা বা মাছ ধরার ‘ভুটভুটি’র জন্য মোটরচালিত পাম্প দরকার হয়। চোরাই মোটরবাইকের ইঞ্জিন সেই ‘পাম্পে’র কাজে ব্যবহৃত হয়। দাম, দু’-তিন হাজার টাকা। জেলে-নৌকার জন্যও এক সময় ইঞ্জিন বাংলাদেশে পাচার হতো বলে পুলিশের দাবি। এ ছাড়া ভিন্-রাজ্যেও পাচার হয় চোরাই মোটরবাইক। সে ক্ষেত্রে দাম পড়ে, হাজার দশ-বারো হাজার টাকা।

সূত্রের খবর, মোটরবাইক চোরদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে কিছু গ্যারাজ মালিকের। মোটরবাইক চুরি করে অনেক সময়েই চোরেরা তা গ্যারাজে নিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে মোটরবাইকের ইঞ্জিন, টিউব, টায়ার-সহ নানা অংশ আলাদা করে কিনে নেন ওই মালিকেরাই। ফলে, মোটরবাইকটি কার্যত পুলিশের নাগালের বাইরে চলে যায়।

পুলিশ জানায়, সাধারণত, একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের মোটরবাইকই বেশি চুরি হচ্ছে। কারণ, মেকানিকদের মতে, ওই ব্র্যান্ডের মোটরবাইকের ইঞ্জিনটি প্রযুক্তিগত কোনও বদল ছাড়াই পাম্প বা ভুটভুটিতে ব্যবহার করা যায়। তাই চোরেদের কাছে তার কদর বেশি।

তবে মোটরবাইক চুরির তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ এলাকার জনপ্রতিনিধি থেকে বাসিন্দা—সকলেই। রানিগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক রুনু দত্তের ক্ষোভ, ‘‘প্রায়ই শুনি, মোটরবাইক চুরি হলেও থানা অভিযোগ নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই আদালতের দ্বারস্থ হন।’’ পুলিশি-ভূমিকায় আইনি জটিলতাও বাড়ছে বলে মত রানিগঞ্জের কুমারবাজারের বাসিন্দা আইনজীবী রত্নপানি মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ মোটরবাইক-চুরির মামলা শুরু করে না। অথবা, চালু করলেও মাস দুয়েক দেরিতে করে। এর ফলে ওই মোটরবাইক নিয়ে কোনও অপকর্ম হলে আইনি জটিলতায় ফেঁসে যেতে পারেন মোটরবাইকের প্রকৃত মালিক।

মোটরবাইক চোরদের মধ্যে জেলা এবং ভিন্-জেলা, উভয় এলাকারই বাসিন্দা রয়েছে। রানিগঞ্জ থানার দাবি, গত চার মাসে মোটরবাইক চুরির ঘটনায় সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বীরভূমে বাড়ি দু’জনের। বাকি চার জন দুর্গাপুর এবং এক জন আসানসোলের বাসিন্দা। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এ়়ডিসিপি (‌সেন্ট্রাল) জে মার্সি বলেন, ‘‘এলাকায় মোটরবাইক চুরি হচ্ছে এ কথা ঠিক। তবে আমরা পাঁচটা চোরাই বাইক এর মধ্যেই উদ্ধার করেছি।’’ তাঁর আশ্বাস, শহরের যে সব জায়গায় বেশি সংখ্যায় মোটরবাইক পার্ক করা হয়, সেই সব এলাকায় নজরদারি বাড়াবে পুলিশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement