মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
দার্জিলিং চায়ের নামে বাজারে নেপালি চা বিক্রি করা হচ্ছে! যার জেরে বিশ্বখ্যাত দার্জিলিং চায়ের ‘বদনাম’ হচ্ছে বলে দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে উত্তরবঙ্গের চা-মহল। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নকল দার্জিলিং চা’-মন্তব্যে সেই বিতর্ক আবার ফিরে এল।
বুধবার ম্যাল-চৌরাস্তায় সরস মেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, দার্জিলিং চায়ের নামে বাজারে আজকাল ‘বাজে চা’ বিক্রি হচ্ছে। দার্জিলিং চা নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি আমেরিকা, ব্রিটেনে গিয়েছি। সেখানে বিমানবন্দরে দার্জিলিং চায়ের প্যাকেট দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আজকাল কিছু সমস্যা হচ্ছে। দার্জিলিং চায়ের নামে বাজে চা বাজারে ছাড়া হচ্ছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পরিস্থিতি যা, তাতে দার্জিলিং চায়ের বদনাম করা হচ্ছে। এটা আমরা হতে দেব না। আমরা সরকারি ভাবে এ বিষয়টি বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’’
পাহাড়ের চা ব্যবসায়ীদের একাংশের বক্তব্য, তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে যে অভিযোগ করছেন, তা-ই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের মতে, ‘বাজে চা’ বলতে প্রকারান্তরে নেপালি চায়ের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন মমতা। তাঁর ওই উদ্বেগ সঙ্গত বলেও মনে করছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে নেপালি চায়ের কথা না-থাকলেও, তেমনটাই মত প্রশাসনিক মহলের। যদিও প্রশাসনের তরফে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেননি।
চা ব্যবসায়ীদের একাংশ জানাচ্ছেন, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে দার্জিলিং ও নেপাল পাহাড়ের কিছুটা মিল রয়েছে। তাই নেপালের কিছু এলাকার চা স্বাদের দিক থেকে অনেকটা দার্জিলিং চায়ের কাছাকাছি। স্বাদে, গন্ধে যার সঙ্গে ‘খানদানি দার্জিলিং চা’-এর তফাৎ করা সম্ভব নয় সাধারণ চোখে। দার্জিলিং চায়ের উৎপাদন কমার সুযোগ নিয়ে সেই নেপালি চা ভারতের খোলা বাজারে ঢুকছে। চড়া দামে বিকোচ্ছে বিদেশের বাজারেও। দুই চায়ের মধ্যে দৃশ্যত ফারাক খুব সূক্ষ্ম হলেও গুণগত মানের দিক থেকে আকাশ-পাতাল তফাৎ। যে কারণে দার্জিলিং চায়ের সুখ্যাতি নষ্ট হচ্ছে বলে অনেক দিন ধরেই রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অভিযোগ করে আসছে চা সংগঠনগুলি।
দার্জিলিঙের ‘টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য তথা শিমূলবাড়ি চা-বাগানের মালিক মহেন্দ্র বনসল বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্বেগ যথাযথ। দার্জিলিং চায়ের ক্ষেত্রে টি বোর্ডের অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয় আমাদের। কিন্তু নেপালি চায়ের ক্ষেত্রে এ সবের বালাই নেই। কিন্তু ওই চা-ই এখন ভারতের বাজারে ছেয়ে গিয়েছে। আর বদনাম দার্জিলিং চায়ের হচ্ছে। আমরা ঠিক ভাবে দামও পাচ্ছি না। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কোনও সমাধান হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী এই প্রথম বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।’’
চা-বাগানের মালিকেরা জানাচ্ছেন, ২০১৭ সালে ১০৪ দিন পাহাড়ে বন্ধ হয়েছিল। দার্জিলিঙের চা-বাগানগুলি বন্ধ ছিল সেই সময়ে। সেই বন্ধের সুযোগ নিয়ে দেশের বাজারে নেপালি চা ঢুকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় চা-বাগান খুললেও, তত দিনে নেপালের চা বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই নেপালের চা-কে ‘দার্জিলিং চা’ বলে বিক্রি শুরু হয়ে যায় ভারতের বাজারে। দার্জিলিং লাগোয়া নেপাল সীমান্ত। সেখানেই রয়েছে নেপালের ছোট থেকে বড় বহু বাগান। প্রতি বছর পানিট্যাঙ্কির সীমান্ত দিয়ে লক্ষ লক্ষ কেজি চা শুল্ক দফতরের নাকের ডগা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এর জন্য কোনও করও লাগে না। পরীক্ষা করা হয় না চায়ের গুণগত মানও। সেই সব নেপালের চায়ের বস্তা চলে যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন গুদামে। সেখানেই নেপালের চা দার্জিলিং চায়ের প্যাকেটে মুড়ে ভারত ও বিদেশে পাঠানো হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে নেপাল থেকে আসা চায়ের মান পরীক্ষার দাবি তুলেছে চা সংগঠনগুলি। সম্প্রতি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও মান নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ (ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা এফএসএসএআই) নেপাল থেকে আমদানি করা চায়ের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করার কথা বলা হলেও, তা ঠিকঠাক মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। ‘প্ল্যানটার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর এক সদস্যের দাবি, ‘‘নেপালের ভেজাল চা রুখতে খুব একটা সক্রিয় নয় ভারত সরকার। হয়তো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনও বিষয় রয়েছে। হয়তো প্রতিবেশী দেশ নেপালকে চটাতে চাইছে না সরকার।’’
দার্জিলিঙের নররুং চা-বাগানের মালিক সতীশ মিত্রুকা বলেন, ‘‘চা শিল্প কেন্দ্রের বাণিজ্য মন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত। অনেক বার সেখানে চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু সুরাহা হয়নি। নেপালের চা আমদানি যদি বন্ধ করা না যায়, তা হলে অন্তত টি বোর্ডে নিলাম হোক। তা হলেই সব ধরা পড়ে যাবে। কেন সীমান্ত থেকে সরাসরি বাজারে চলে যাচ্ছে নেপালের চা? নিয়ম মেনে হাতে শংসাপত্র নিয়ে বাজারে আসুক না। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’’
চা ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, খোলা বাজারে নেপালি চায়ের এই আধিপত্য বিস্তার রুখতে রাজ্য সরকারকে আরও সতর্ক এবং সক্রিয় হতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর রাজ্যের আরও চাপ সৃষ্টি করা উচিত বলেও মনে করছেন তাঁরা। সিংগুলি চা-বাগানের মালিক হর্ষ বেরেলিয়া বলেন, ‘‘যে হারে নেপালি চা বাংলায় ঢুকছে, তাতে আমাদের ব্যবসা মাথায় উঠেছে। শিলিগুড়ির বাজারে এখন ৮০ শতাংশ নেপালের চা। এটা বন্ধ না হলে আমাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। রাজ্যই পারে এটা বন্ধ করতে। কারণ, নেপালের চা বাংলা দিয়েই ঢুকছে। সরকারি হস্তক্ষেপ ভীষণ ভাবে প্রয়োজন এই মুহূর্তে। দার্জিলিং চায়ের জিআই ট্যাগ (ভৌগোলিক নির্দেশক) রয়েছে। নেপালি চায়ের জন্য তা তো হারাবই আমরা, আগামী দিনে বাজারেও আর দার্জিলিং চা পাওয়া যাবে না।’’
টি অ্যাশোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক সুমিত ঘোষও বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যদি ভেজাল দার্জিলিং চা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন, তা হলে সেটাকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। এর জন্য সত্যিই কড়া নজরদারির প্রয়োজন। এমনিতেই আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় চা শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। তার উপর বাজারে ভেজাল চা! শুধু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই চা শিল্প বাঁচবে এবং ঘুরে দাঁড়াবে।’’