পুলিশ ফাটল থেকে

মুণ্ডেশ্বরীর চরে দুই দেহ, শাস্তি চান মা

২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হুগলি ঘেঁষা ওই এলাকায় পিটিয়ে খুন করা হয় দুই তৃণমূল কর্মীকে। মু্ণ্ডেশ্বরীর পাড়ে পাশাপাশি দেহ মেলে তাঁদের। সঙ্গে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ, পুলিশকে ঢুকতে বাধা, রাস্তা কাটা, বোমাবাজি— জুড়ে যায় এ সব

Advertisement

সৌমেন দত্ত

জামালপুর শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৮
Share:

২০১০ সালে সিপিএমের সশস্ত্র হামলায় খুন হন দুই তৃণমূল কর্মী।

Advertisement

গ্রাম দখলের লড়াইয়ে বাসিন্দারাই কৌশলে তাদের মেরেছে বলে পাল্টা অভিযোগ করে সিপিএম।

১৮ জন অভিযুক্ত ধরা পড়ে। জামিনে ছাড়াও পেয়ে যায়।

Advertisement

আপাতত প্রথম পর্যায়ের শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

ভোটের তখনও কয়েক মাস দেরি। পুরোদমে শুরু হয়েছে গ্রাম দখলের লড়াই, রাজনীতি।

তবে জেলার আর পাঁচটা জায়গার থেকে দামোদর, মুণ্ডেশ্বরীর মাঝের জামালপুরের জ্যোৎসারি পঞ্চায়েতের আটটি গ্রামে ভোটের আঁচটা বোধহয় একটু বেশিই।

২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হুগলি ঘেঁষা ওই এলাকায় পিটিয়ে খুন করা হয় দুই তৃণমূল কর্মীকে। মু্ণ্ডেশ্বরীর পাড়ে পাশাপাশি দেহ মেলে তাঁদের। সঙ্গে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ, পুলিশকে ঢুকতে বাধা, রাস্তা কাটা, বোমাবাজি— জুড়ে যায় এ সবও।

সেদিন সকাল ১১টা নাগাদ চাল কিনতে বাজারে গিয়েছিলেন তৃণমূল সমর্থক ঈশা হক মল্লিক। ফেরার পথে নিজের গ্রাম উজিরপুরে সিপিএমের সশস্ত্র মিছিলের মাঝে পড়ে যান তিনি। আর ঘরে ফেরেননি চাষবাস করে দিন কাটানো ঈশা।

উজিরপুর থেকে কিছুটা দূরে আর এক গ্রাম অমরপুর। সেখানেও সেদিন সবে দুপুরবেলায় বারান্দায় ভাত খেতে বসেছিলেন স্বচ্ছল চাষি পাঁচু দাস। তখনই বেশ কয়েকজন সিপিএমের দুষ্কৃতী বাড়িতে ঢুকে তুলে নিয়ে যায় পাঁচুবাবুকে। ভাঙচুর চলে। পরে গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে নদীর চরে ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ মেলে দু’জনের।

তৃণমূলের অভিযোগ, লোকসভা নির্বাচনের পরে গোটা রাজ্যের সঙ্গে জামালপুরেও সিপিএমের পায়ের তলার মাটি আলগা হতে শুরু করে দিয়েছিল। সেই মাটি যাতে মুণ্ডেশ্বরীর বালির মতো ধসে না পড়ে, তাই গ্রাম দখল শুরু করে সিপিএম। তারই বলি হন দুই প্রবীণ ঈশা হক মল্লিক (৫৪) ও পাঁচু দাস (৬২)। সিপিএমও পাল্টা দাবি তোলে, তৃণমূল বারবার মুণ্ডেশ্বরীর এক পাড় রায়না থেকে এ দিকের গ্রাম দখল করতে হামলা চালাচ্ছিল। ওই দিন গ্রামের বাসিন্দারা কৌশলে পাল্টা জবাব দেন। রায়না থেকে তৃণমূল লোক নিয়ে গ্রাম দখল করতে এলে বাসিন্দারা তাদের ভিতরে ঢুকতে দিয়ে মুণ্ডেশ্বরীর চরে সর ঘাসের মধ্যে ঢুকে পড়েন। পরে বাইরে থেকে তির-ধনুক নিয়ে প্রতিরোধ শুরু হয়। তৃণমূল বোমা ছুড়লেও বালিতে পড়ে তা ফাটছিল না। সেই গোলমালের সময়ে পালাতে না পেরে প্রাণ যায় ওই দু’জনের।

ঘটনার পরে পাঁচুবাবুর ভাইপো প্রবীর ১৮ জনের নামে জামালপুর থানায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। সিপিএমের হামলায় তৃণমূল কর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর, দলীয় দফতর ভাঙচুর, এমনকী, তিরের ঘায়ে বেশ কয়েকজন গুরুতর জখমও হয়েছিলেন বলে এফআইআরে জানান প্রবীরবাবু। আবারহ ময়না-তদন্তের পরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেহ গ্রামে আনার সময়ে তৃণমূলের লোকজন পুলিশের উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ। পুলিশের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। অবস্থা সামলাতে জামালপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে সে সময় তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও মুকুল রায়দের বলতে হয়, “পুলিশকে আক্রমণের নিশানা বানাবেন না।” বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিহতদের স্মরণে সভা করেন। ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর চার অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অবশ্য সবাই জামিনে ছাড়া পেয়ে যান।

ঈশা হকের ভাই মহম্মদ হোসেন মল্লিক বাড়ির দাওয়ায় বসে বলেন, ‘‘দাদা স্পষ্টবাদী ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গেও সে ভাবে যোগ ছিল না। ওই দিন বাড়ির কাছেই একটি চায়ের দোকান থেকে রেসালতপুরে মুণ্ডেশ্বরীর চরে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয় তাঁকে।” পাঁচুবাবুর বৌদি তিলকাদেবীও বলেন, “সে দিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলতে পারিনি। বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল দুষ্কৃতীরা। আমরা ভয়ে ছুটোছুটি করছি। ভাতের থালা ফেলে দেওরকে তুলে নিয়ে যায় ওরা। আর ফিরল না।”

জামালপুরের তৃণমূল প্রার্থী উজ্জ্বল প্রামাণিকের অভিযোগ, “দুটি খুন করার পরেও সে দিন সিপিএমের উল্লাস থামেনি। পরিজনেদের শেষ দেখাও দেখতে দেয়নি।” সিপিএমের জামালপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক সমর ঘোষ বলেন, “সে দিন তৃণমূল রেসালতপুর দখল করতে এসেছিল। গ্রাম দখল করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।”

পুলিশ জানিয়েছে, খুনের ঘটনার প্রথম পর্যায়ে শুনানি শেষ হয়ে গিয়েছে। ১৩ জন বর্ধমান আদালতে সাক্ষ্যও দিয়েছেন।

রাজনীতির, গ্রাম দখলের লড়াই থেকে দূরে ঈশা হকের মা মর্জিনা মল্লিকেরও কাতর আর্জি, ‘‘বুক ফেটে যায়। শাস্তি হোক ছেলের খুনির।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement