চতুর্থীর দিন, বুধবার রাতে কল্যাণপুর আদি সর্বজনীনের মণ্ডপে ভিড়। —নিজস্ব চিত্র।
সুশান্ত বণিক
আসানসোল
মহাভারতের যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক কারিগরি নিদর্শন। বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ থেকে ‘চন্দ্রযান৩’-এর সফল উৎক্ষেপণ। এ সব নিয়েই এ বার সেজে উঠেছে আসানসোল শিল্পাঞ্চলের দুর্গাপুজোর বিভিন্ন মণ্ডপ। এ সব থিমের মাঝেও হারিয়ে যায়নি শহরের প্রাচীন সাবেক পুজোর জাঁকজমক। শহরের এই রূপ দেখতে চতুর্থীর সন্ধ্যাতেই পুজোর মণ্ডপগুলিতে মানুষের ঢল নামতে শুরু করেছে।
কখনও ট্রেনে কাটা পড়ে অথবা চোরা শিকারিদের জন্য মৃত্যু হচ্ছে হাতির। আপাত নিরীহ এই প্রাণি সম্প্রদায়টিকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন আসানসোলের ‘কল্যাণপুর স্কিম টু’ পুজোর উদ্যোক্তারা। মণ্ডপের পরতে পরতে হাতির প্রাণ সংশয়ের কথা ব্যাখ্যা করে, শিল্পী সত্তার মাধ্যমে কী ভাবে হাতি রক্ষা করা যায়, উদ্যোক্তারা তা তুলে ধরেছেন। ৪২ বছরে পড়ল এই পুজো। শহরের অন্যতম বিগ বাজেটের পুজো আসানসোল আপকার গার্ডেন সর্বজনীন। রাজ্যের মন্ত্রী তথা আসানসোল উত্তরের বিধায়ক মলয় ঘটক নিজে পুজোর চেয়ারম্যান। পুজোর থিম ভাবনা ‘সোনার রথ’। উদ্যোক্তারা জানালেন, শাস্ত্রমতে এ বার দুর্গার আগমন ঘোড়ায় চড়ে। সেই ভাবনা থেকে এ বার ঘোড়ায় টানা সোনার রথ বানানো হয়েছে। মহাভারতে অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। অবিকল সেই আদলেই তৈরি করা হয়েছে
রথ। এ বার এই পুজো ৮৪ বছরে
পা দিয়েছে।
শিল্পাঞ্চলের বহু পুজোয় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বিগ বাজেটের পুজোয় বরাবরের মতো এ বারও আসর মাতাচ্ছে কোলিয়ারির শ্রমিক-কর্মীদের পুজো। মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ারের আদলে মণ্ডপ তৈরি করে তাক লাগিয়েছে ধেমোমেন কোলিয়ারির পুজো। উদ্যোক্তাদের দাবি, এই থিম শিল্পাঞ্চলে এ বারই প্রথম। তৃতীয়াতেই
পুজোর উদ্বোধন করেছেন ডাইরেক্টর (টেকনিকাল) নীলাদ্রি রায়। বুধবার মণ্ডপ দেখতে ঢল নেমেছিল। বিজ্ঞানের অবদান ও দেশের সাফল্যকে এ বার মণ্ডপের থিম করেছেন চিত্তরঞ্জনের সিমজুড়ি সর্বজনীন পুজো উদ্যোক্তারা। চন্দ্রযান৩-এর অভিযানের প্রতিটি মুহূর্তকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশাপাশি, ভিন্-দেশি সংস্কৃতিকেও এ বার মণ্ডপে তুলে ধরেছেন উদ্যোক্তারা। বারাবনির পাঁচগাছিয়া গান্ধীনগর পুজো কমিটির থিম ‘আফ্রিকার মৎস্য উৎসব’। সে দেশের আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজন কী ভাবে মাছ ধরেন, তাঁদের মাছ ধরার প্রতিযোগিতা ও কী ভাবে মৎস্য নির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছে— সে সবই মণ্ডপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা জানালেন, ভিন্ দেশের মৎস্যজীবীরা কী ভাবে এই ব্যবসা করে নিজেদের স্বনির্ভর করে তুলেছেন, তা পাঁচগাছিয়া পঞ্চায়েত অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের দেখানো ও হাতে-কলমে শেখানোর জন্যই এই থিম ভাবনা।
থিমের ভিড়ে নিজস্বতা হারায়নি শহরের প্রাচীনতম আসানসোল গ্রামের পুজো। পঞ্চোকোট রাজা গরুড় নারায়ণ সিংহদেও-র আমলে প্রতিষ্ঠিত এই পুজোর বয়স এ বার ২৮৯ বছর। সাবেক রীতির প্রতিমা ও নিষ্ঠার পুজাচারই এখানে প্রধান।
বিগ বাজেটই হোক বা সাবেক। পুজোর খরচ গতবারের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে বলে বলে জানালেন উদ্যোক্তারা। যেমন গান্ধীনগর পুজো কমিটির সভাপতি মনোরঞ্জন মণ্ডল বলেন, “মণ্ডপ সাজানোর সামগ্রীর দাম বেড়েছে। বেড়েছে ডেকোরেটর কর্মীদের মজুরিও। এ সবের দাম মেটাতে বাজেট বাড়ানো হয়েছে।” আসানসোল গ্রাম পুজোর সভাপতি শচীন রায় জানালেন, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। শিল্পী থেকে কর্মী প্রত্যেকেরই জীবন-যাপনের খরচ বেড়েছে। স্বভাবতই তাঁরাও মজুরি বাড়িয়েছেন। সে সব সামলাতে বাজেট বেড়েছে। তাঁদের কথায়, “কষ্ট করে হলেও তা জোগাড় করতে হচ্ছে। কারণ, বছরে তো এই একটাই বড় উৎসব।”