আগের বারের বর্ধমান পুরভোটে তৃণমূলের ভয়াবহ সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে সাত সকালেই ওয়াকওভার করেছিল সিপিএম। তারপর বছর পার। ১৬-০-র শহর মেমারিতে এ বার পুরভোট। যদিও সিপিএম নেতৃত্বের আশঙ্কা, ইতিমধ্যেই যেভাবে প্রার্থী প্রত্যাহারে চাপ দেওয়া হয়েছে বা মারধর, দেওয়াল লিখন মুছে দেওয়া চলছে তাতে এ বারেও মানুষ কতখানি স্বচ্ছ ভাবে ভোট দিতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
মাস ছয়েক আগেও অবশ্য সিপিএম নেতাদের মুখে সন্ত্রাসের অভিযোগ নয় বরং ময়দানে নেমে লড়াই করার কথা শোনা যাচ্ছিল। সিপিএম নেতা বিনয় কোঙারের স্মরণসভাকে কেন্দ্র করে মেমারিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল সিপিএম। রেলগুদাম মাঠের ওই সভায় যোগ দিয়েছিলেন বিমান বসু। প্রকাশ্যে জনসভায় তৃণমূলের দুর্নীতি অভিযোগ তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘হাসপাতালে সিপিএমের লোকেরা চিকিৎসার জন্য গেলেও তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই হাসপাতাল বিনয়বাবুর পরিবারের করে দেওয়া।’ তাঁর আক্রমণাত্মক মন্তব্যে নেতা-কর্মীরাও অনেকটাই উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সিপিএমের মেমারি মধ্য লোকাল কমিটির সম্পাদক সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও দাবি করেছিলেন, “তৃণমূলকে নিয়ে তো শহরে ঢিঢি পড়ে গিয়েছে। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির ঘটনা তো তৃণমূলের কিছু কাউন্সিলরই ঢাক পিটিয়ে বলে চলেছেন। ঠিকমতো ভোট হলে আমরাই ১৬টা আসনে জিতব।’’ তাঁর আরও দাবি ছিল, ‘‘আমরা এখন প্রতিটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে সভা, মিছিল করছি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন।’’
তবে পুরভোট যত কাছে আসছে ততই সিপিএমের মুখে শোনা যাচ্ছে সন্ত্রাস, প্রার্থীদের মারধর, পোস্টার ছেঁড়ার অভিযোগ। নেতারা সাফ জানাচ্ছেন, এ বার জেলার গ্রামীণ এলাকার চার পুরসভা নির্বাচনে দলের ভরসা মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ। সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক স্পষ্ট বলেন, “নির্বাচনের দিন আক্রমণ হলে মানুষ যদি প্রতিরোধ করেন, নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারেন তাহলে এ বার পুরসভার ফল অন্য রকমের হবে। আর মানুষ যদি তা না করতে পারেন তাহলে ভোট লুঠ হবে।”
পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে বির্পযয়ের জন্যও সন্ত্রাস, রিগিংকে দায়ী করেছিল সিপিএম। দলের ২৩তম জেলা সম্মেলনের খসড়া রিপোর্টের নির্বাচনী সংগ্রাম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই আমাদের জেলায় তৃণমূল ভয়ঙ্কর আক্রমণ সংগঠিত করে। আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে।’ এই পরিস্থিতিতেও বেশির ভাগ আসনেই মনোনয়ন দেয় সিপিএম। কিন্তু ‘পুলিশ-প্রশাসন ও তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনীর যৌথ আক্রমণে’ পঞ্চায়েতের ৭৩৬টি, পঞ্চায়েত সমিতির ১২০টি ও জেলা পরিষদের ২টি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে দল বাধ্য হয়েছএ দাবি করা হয় ওই খসড়ায়। রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়, ‘‘ভোটের দিন সকাল থেকেই পুলিশের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের আটকানো হয়। এতদসত্বেও মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে যতটুকু ভোট দিতে পেরেছিলেন তাও প্রশাসনের সহায়তায় ১৪টি পঞ্চায়েত সমিতির গণনাকেন্দ্রে এবং জেলা পরিষদের ৪১টি আসনের গণনাকেন্দ্রে কারচুপি করে তৃণমূল প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করে দেয়।’’
এরপরে লোকসভা নির্বাচনের আগে সিপিএমের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল যে জনগণ শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না, বুথ সুরক্ষিত থাকবে কি না? পরে দলের সাংগঠনিক রিপোর্টে কবুল করা হয়, ‘‘প্রশাসনের (সাধারণ ও পুলিশ) নিরপেক্ষতার অভাব, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবীতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে জেলা কমিটির পক্ষ থেকে বহু অভিযোগপত্র পাঠিয়েও কোনওরকম সাহায্য বা কার্যকরী পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ফলে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের গুণ্ডারা বুথে বুথে তাণ্ডব করে ভোট নিয়ন্ত্রন করল।’’ সিপিএম স্বীকার করে, ‘‘আত্মসমালোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আস্থার ফলে আমরা প্রতিরোধের ইচ্ছাটাই জাগিয়ে তুলতে পারিনি।”
এই পরিস্থিতিতে এ বার পুরভোট হবে রাজ্য পুলিশ দিয়ে। পুলিশ যে নিরপেক্ষ থাকবে না তাতে সন্দেহ নেই সিপিএমের। নেতাদের আশঙ্কা, এ বারও বহু বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেওয়া হবে। ঠিক যেমনটি করা হয়েছিল বর্ধমানের পুরভোটে। বাম নেতারা জানান, বর্ধমানের পুরভোটের সময় ভোট শুরুর প্রায় সঙ্গেসঙ্গে সিপিএম তথা ফ্রন্ট সমস্ত প্রার্থীদের বাধ্য হয়ে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। গুসকরাতে হামলা হয়। কিন্তু সেখানে প্রতিরোধের রাস্তায় যায় সিপিএম। ওই পুরসভার পাঁচটি আসনে জয়ও পায়।
প্রশ্ন উঠছে, এ বার বুথ দখল করে তৃণমূলের লোকেরা ভোট দিতে শুরু করলে সিপিএম কি করবে? সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অমল হালদারের দাবি, ‘‘তেমনটা যে হতে পারে, সে আশঙ্কাও রয়েছে আমাদের। তবে আমরা এ বার সর্বশক্তি নিয়ে ভোট যুদ্ধে নামব।’’