কান্দরার সেই বাড়ি। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভাড়াবাড়ির দোতলার ঠাকুরঘরে গলাকাটা তরুণী বধূর দেহ। দোতলারই রান্নাঘরে মিলেছিল বৃদ্ধা বাড়িওয়ালির গলাকাটা দেহ।
প্রাথমিক ভাবে বিবাহ-বর্হিভূত সম্পর্কের জেরে খুন মনে করে তরুণীর স্বামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, বাড়িওয়ালির গয়নার লোভেই ওই জোড়া খুন।
২০১১ সালের ১ অক্টোবর দুর্গাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় কেতুগ্রামের কান্দরার ওই ঘটনায় ছ’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। চার্জশিটে বাদ যায় স্বামীর নাম। তবে ঘটনার পাঁচ বছর পার হতে চললেও খুনের মামলার কিনারা হয়নি। বাড়ির কেউ জড়িত কি না, কীভাবে খুন হয়েছিল তা-ও নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। অভিযুক্তদের আইনজীবীর দাবি, বাড়ির একমাত্র ছেলে এখনও আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসায় সন্দেহ দানা বাঁধছে আরও।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কান্দরা ডাকবাংলো মোড়ের কাছে বৃদ্ধা রেখারানি রায়ের (৬৭) বাড়িতে ওই বছর অগস্টের মাঝামাঝি ভাড়া আসেন কাটোয়া পঞ্চবটি পাড়ার সুয়াজ মাঝির স্ত্রী গৌরিদেবী (২২) ও তাঁদেরই পড়শি রূপক বৈরাগ্য। রূপক কান্দরাতেই একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন। গৌরিদেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বলেও জেনেছিল পুলিশ। ঘটনার দিন রূপক দাবি করেছিলেন, কিছুদিন ধরেই সুয়াজ গৌরিকে খুনের হুমকি দিচ্ছিলেন। ১ অক্টোবরের রাতে তিনি ফিরে দেখেন দোতলার ঠাকুরঘরে গৌরি ও রান্নাঘরে রেখারানিদেবীর নলিকাটা দেহ পড়ে রয়েছে। পরে মুর্শিদাবাদের সালারের মাঝিপাড়ার বাসিন্দা গৌরিদেবীর মা তুলসী মাঝিও দাবি করেন, খুনের পিছনে জামাই সুয়াজের হাত রয়েছে। কারণ, রূপকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে কান্দরায় আসার পর থেকেই সুয়াজ হুমকি দিত। সেই মতো ঘটনার পরেই সুয়াজকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ দাবি করে, জেরায় খুনের কথা স্বীকারও করেছে সুয়াজ। তারপরেই বদলে যায় গল্প।
জোড়া খুনের ঘটনার তদন্তকারী অফিসার জয়জিৎ লোধ দাবি করেন, পুলিশের হেফাজতে আসার পর থেকেই সুয়াজ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা ক্রমাগত অস্বীকার করতে শুরু করেন। এ দিকে, রেখারানিদেবীর পরিবারের সদস্যেরা জানান, তাঁদের বাড়ি থেকে গয়না-সহ নানাবিধ জিনিস চুরি হয়েছে। তাঁর মেয়েরা জানান, মায়ের কানের দুলজো়ড়া ছাড়া সব গয়নাই হাওয়া। তখনই ঘটনাটি নতুন ভাবে দেখতে শুরু করে পুলিশ। তল্লাশি চালিয়ে অজয়ের কাশীরামদাস সেতুর কাছ থেকে এক জনকে ধরে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় ধৃত যুবক ঘটনার কথা স্বীকার করে। ঘটনায় কারা কারা ছিল, সেটাও পুলিশকে জানায়। গয়না ও টাকা হাতাতে গিয়েই তাঁরা খুন করে ফেলেছে বলেও জেরায় ধৃত স্বীকার করে বলে পুলিশের দাবি। পরে পুলিশ আরও পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। এক জনের কাছ থেকে বেশ কিছু গয়নাও উদ্ধার হয়। ধৃতদের কাছ থেকে মিথাইল অ্যালকোহলের বোতল, বেশ কিছু গয়না, ধারালো অস্ত্র, রক্ত লাগা নাইলনের দড়ি উদ্ধার করে পুলিশ।
দু’মাসের মধ্যে চার্জশিট পেশ করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, রেখারানিদেবীকে প্রথমে মিথাইল অ্যালকোহল দিয়ে শ্বাসরোধ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়। পরে গৌরীদেবীকে গলা কেটে খুন করা হয়। চার্জশিট থেকে বাদ যায় গৌরিদেবীর স্বামী সুয়াজ মাঝির নাম। বাকি অভিযুক্তেরা পাঁচ বছর ধরে জেল হেফাজতে রয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তকারী অফিসারের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
পুলিশের দাবি, ধৃতেরা জেরায় জানিয়েছিল, গয়না লুঠের পরিকল্পনা করেছিলেন বাবু সাহা। তিনি ঘটনার বছরখানেক আগে ওই বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিনি এক জনকে নিয়ে ওই বাড়িতে যান। সেই সময় অন্য ধৃতরা পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকে। দোতলায় উঠে রেখারানিদেবীর গা থেকে গয়না খুলে নিতে গেলে বাধা দেন। তখন তাঁকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে তাঁর মাথায় আঘাত, পরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলায় আঘাত করে খুন করা হয়। চিৎকার শুনে গৌরীদেবী একতলা থেকে উপরে উঠে এলে তাঁকেও খুন করে দুষ্কৃতীরা। পুলিশ ধৃতদের নিয়ে কী ভাবে খুন করা হল তার মহড়াও দেয়।
যদিও অভিযুক্তদের আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশের তদন্তে প্রচুর গাফিলতি রয়েছে। এই ঘটনার পিছনে বাড়ির কেউ জড়িত আছে কি না, পুলিশ তা নিশ্চিত করতে পারেনি। আমার সন্দেহ বাড়িয়ে দিচ্ছে, একমাত্র ছেলে আদালতে সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে না আসায়!”