দেওয়ালের পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়ছে। নিজস্ব চিত্র।
যার টানে আসেন অনেক পর্যটক। যাকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার স্বপ্নে বিভোর বর্ধমানের কালনা শহর। সেই প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন কালনা শহরের ১০৮ শিব মন্দিরের নানা জায়গা থেকে খসে পড়তে শুরু হয়েছে ইট ও তার উপরের আস্তরণ। তাই মন্দিরটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরবাসীরা। তাঁদের দাবি, গোড়াতেই পদক্ষেপ না করলে হারিয়ে যাবে গর্বের এই নিদর্শন।
১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর মন্দিরটি গড়েন। মন্দিরটি তৈরি হয় দু’টি বৃত্তে। বাইরের বৃত্তে রয়েছে ৭৪টি মন্দির। আর ভিতরের বৃত্তে ৩৪টি মন্দির। প্রথম বৃত্তে ক্রমান্বয়ে মন্দিরগুলিতে সাজানো রয়েছে সাদা এবং কালো শিব লিঙ্গ। দ্বিতীয় বৃত্তে সব ক’টি মন্দিরেই রয়েছে সাদা শিব লিঙ্গ। এই বৃত্তের একটি জায়গা থেকে সব ক’টি শিব লিঙ্গ দেখা যায়। দু’শো বছরেরও বেশি প্রাচীন মন্দিরটিকে আকাশ থেকে দেখতে লাগে পাপড়ি মেলা পদ্মের মতো। বর্ধমান সদর সহ নানা জায়গায় ১০৮ শিবমন্দির থাকলেও কালনার মন্দিরটির গঠনশৈলী বিরল।
মন্দিরটি দেখভাল করে পুরাতত্ত্ব দফতর। পর্যটকদের কাছে মন্দিরটি আকর্ষণীয় করে তুলতে তারা মন্দিরের ভিতর তৈরি করেছে ফুলের বাগান। বছর খানেক আগে রাজ্য পর্যটন বিভাগের উদ্যোগে মন্দিরে লাগানো হয়েছে আধুনিক আলো। নতুন ভাবে সেজে ওঠার পরে যখন পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে, তখনই মন্দিরটিকে ঘিরে দেখা দিয়েছে অন্য দুশ্চিন্তা। দু’টি বৃত্তেরই গায়ে গায়ে থাকা মন্দিরগুলি বেশ কয়েকটির গা থেকে খসে পড়ছে ইটের টুকরো। লাগাতার নোনা ধরে খসে পড়ার কারণে বহু মন্দিরের গা থেকে হারিয়ে গেছে নকশা, কারুকার্য। কয়েকটি মন্দিরের অবস্থা এতটাই খারাপ যে গায়ের বেশির ভাগ কারুকার্যই নষ্ট হয়ে ভিতরের লাল ইট বেরিয়ে এসেছে। বাইরের বৃত্ত থেকে ভিতরের বৃত্তের মন্দিরগুলির দশা আরও খারাপ। প্রতিটি মন্দিরে ঢোকার মুখে রয়েছে ছোট ছোট কাঠের দরজা। ভিতরে ঢুকলে দেখা যায় ভিতরের অংশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়েছে। শিব লিঙ্গের চার পাশের দেওয়ালে জল জমে রয়েছে। কয়েকটি দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে চাঙর।
শহরবাসীরাও এই ঘটনা নিয়ে চিন্তিত। গৃহবধূ প্রতিমা সরকার জানান, মন্দিরটি এলাকার গর্ব। মন্দির থেকে ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে বহু কারুকার্য। দ্রুত প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ তাই জরুরি। আর এক বাসিন্দা প্রদীপ তালুকদার বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে পুরাতত্ত্ব বিভাগের তরফে মন্দিরের গায়ে কেমিক্যাল ওয়াশ করা হয়েছিল। চেষ্টা হয়েছিল ভেঙে পড়া মন্দিরের কিছু কিছু অংশে দিয়ে মেরামতির। তাতে অবশ্য ফল ভাল হয়নি।’’
কালনা শহরে ঘটা করে পালিত হয় পর্যটন উৎসব। যার মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে শহরে পর্যটকদের ঢল নামানোর। এই উৎসবের উদ্যোক্তা কালনার বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘মন্দিরটির ক্ষেত্রে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ যাতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করে তার জন্য চিঠি পাঠানো হবে।’’ কালনার পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ বাগ বলেন, ‘‘মন্দিরটি দেখভাল করে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। কোথায়, কী ভাবে মন্দিরটি নষ্ট হচ্ছে, তা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরে পুরাতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে পুরসভা।’’
কী বলছেন পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ? সর্বেক্ষণের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা পি কে মিশ্র বলেন, ‘‘পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের আওতায় থাকা যে যে মন্দিরের টেরাকোটার কাজ নষ্ট হচ্ছে, তার বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে কলকাতা সার্কেলের আধিকারিককে। রিপোর্ট দেখে সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হবে।’’ তবে বিষ্ণুপুরের মন্দিরে যে ভাবে বাইরে থেকে লোক এসে কিছু অংশ ভেঙে দিয়েছিলেন, এখানেও সে রকম কিছু ব্যাপার আছে কি না, তা দেখতে হবে।