—নিজস্ব চিত্র।
জুয়ায় সর্বস্ব খুইয়েছিলেন স্বামী। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ঝুপড়ি ঘরও ‘বিক্রি’ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সংসার টানা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। জীবনযুদ্ধে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ বর্ধমানের তেজগঞ্জের আদর্শপল্লির ঊনত্রিশ বছরের ঝুমা কাঞ্জিলাল প্রথমে গৃহ-সহায়িকার কাজ শুরু করেন। তার পরে, শুরু করেন টোটো চালানো। এখন সংসার সামলে দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন ঝুমা।
ঝুমার কথায়, “আমি বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি। ছেলেমেয়েকে পড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম। স্বামী-বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে, প্রথমে লোকের বাড়িতে কাজ করতাম। তাতে ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ উঠত না। আমিও পড়ার সময় ওদের পাশে থাকতে পারতাম না। সে কারণে টোটো চালিয়ে আয় করছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এবং ওদের দু’জন গৃহশিক্ষকের খরচ জোগাচ্ছি।’’
অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি টপকাতেই ঝুমার বিয়ে দিয়ে দেয় তাঁর পরিবার। তাঁর ১২ বছরের ছেলে এখন বর্ধমানের একটি মাধ্যমিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আর ছ’বছরের মেয়ে সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা অলক মণ্ডল, রেবা ঘোষদের দাবি, “খুব কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে ঝুমা। পাড়ার সবাই খুবই উৎসাহ দেয় ওকে।’’
ঝুমার বাপের বাড়িও ওই এলাকাতেই। বাবা শ্যামল ছোট মালবাহী গাড়ির চালক।
মা সান্ত্বনা বলেন, “জামাই রান্নার গ্যাস সরবরাহ করত। দেখাশোনা করে বিয়ে দিয়েছিলাম। কয়েক বছর ভালই চলছিল। জুয়ার নেশা শুরু হতেই সর্বস্ব বিক্রি করতে শুরু করে জামাই। সংসারে নজর ছিল না। ঝুমার উপরে নির্যাতন বাড়ছিল। পাড়ার যুবকেরা জামাইকে এলাকাছাড়া করে।’’
টোটো চালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় ঝুমাকে। তাঁর দাবি, “অবিবাহিত মনে করে অনেকেই উত্ত্যক্ত করছিল। প্রতিবাদও করি। এক জনকে রাস্তায় ফেলে মেরেছিলাম।’’
সকালে ঘরের কাজকর্ম সেরে ছেলেমেয়েদের পড়ান ঝুমা। তার পরে, টোটো নিয়ে রাস্তায় নামেন। বর্ধমান শহরের বিভিন্ন অলিগলি থেকে শুরু করে রায়নার পলাশন—টোটো নিয়ে ছোটেন অনেক জায়গাতেই। বাড়ি ফেরার পথে, ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে টোটোয় তুলে নেন।
ঝুমার কথায়, “যে টাকা আয় করি, তাতে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ উঠে যায়। কাছে না থাকলে, ওরা পড়তে বসতে চায় না। সে কারণে সন্ধ্যার সময় বই নিয়ে বসে পড়ি ওদের সঙ্গে।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘আমারও আবার পড়াশোনা শুরু করতে ইচ্ছা করে। ছেলেমেয়েরা স্বনির্ভর হবে, আমাদের একটা বাড়ি হবে—এটাই স্বপ্ন। স্বপ্নপূরণের লড়াই লড়ে চলেছি।’’
সামনেই মেয়ের পরীক্ষা। তাই কথা না বাড়িয়ে টোটো চালু করেন ঝুমা। যাওয়ার আগে বললেন, ‘‘পরীক্ষার কী আর শেষ আছে! প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা দিচ্ছি।’’