পর্যটকের অপেক্ষায় মাগনপুরের মসজিদ।
এক সকালে নদীতে নেমে ধ্যান করছিলেন সারঙ্গ দেব। আচমকা গায়ে কিছু একটা ঠেকায় ধ্যান ভাঙে তাঁরা। দেখেন এক কিশোরের মৃতদেহ ভেসে এসেছে। তৎক্ষণাৎ ওই কিশোরের দেহে প্রাণ সঞ্চার করেন তিনি।
এ রকম শ্রুতিকথা তো বটেই, চাঁদের বিল, বাঁশদহ বিল থেকে চৈতন্যদেবের নানা স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে পূর্বস্থলীতে। অভাব রয়েছে শুধু পর্যটকদের কাছে সেই আকর্ষণের সম্ভার পৌঁছে দেওয়ার। তবে এলাকায় পর্যটনের হাল ফেরাতে এ বার উঠেপড়ে লেগেছে পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতি। রাজ্য পর্যটন দফতরে দেড় কোটি টাকার একটি পরিকল্পনাও পাঠিয়েছেন তারা।
শোনা যায়, নবদ্বীপের গা ঘেঁষা বর্ধমানের এই এলাকায় একসময় যাতায়াত ছিল চৈতন্যদেবের। বহু বিখ্যাত পণ্ডিতের বাসও ছিল এলাকায়। এমনকী, উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের বাড়িও ছিল এলাকার বিদ্যানগর গ্রামে। এখনও ওই গ্রামে রয়েছে শ্রীসার্বভৌম মঠ। কাছাকাছি গঙ্গানন্দপুরে আবার ছিল গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোল। সেখানে শিক্ষা লাভের জন্য আসতেন মহাপ্রভু। গঙ্গানন্দপুরে গেলে সেই বিদ্যাচর্চার স্থানটিও দেখা যায়। জাহান্নগর গ্রামে আবার রয়েছে গুরুশিষ্যের নামে সারঙ্গমুরারি মঠ। সারঙ্গদেব ছিলেন শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে আসার সময় চৈতন্যদেব তাঁর সঙ্গেও দেখা করতেন। জাহান্নগর পঞ্চায়েতের মাগনপুর গ্রামের ইতিহাসও বহু পুরানো। মাঙন (ভিক্ষা) থেকে গ্রামের নাম হয় মাঙনপুর। কথিত আছে নিমাই পণ্ডিত সন্ন্যাস নেওয়ার পরে ভিক্ষা চাইতে এই গ্রামে এসেছিলেন। সেই থেকেই এমন নাম। এ ছাড়া এছুরত গ্রামের পিরবাবা বুড়ো খনকারের মাজারও একটি দর্শনীয় স্থান। উত্তর শ্রীরামপুরে রয়েছে প্রাচীন রাধাগোবিন্দ জীউ মন্দির। শোনা যায়, টোলে পড়াশোনা শেষ করে নিমাই এখানে বিশ্রাম নিতেন। ভাণ্ডারটিকুরি এলাকায় কপিল মুনির আশ্রমও রয়েছে। এখানকার যজ্ঞের আগুনজ্বলে বছরভর। ব্রম্ভাণীদেবীর মন্দিরও রয়েছে এখানে। কুঠিরপাড়ার তপোবন আশ্রমের বয়সও প্রায় ৫০০ বছর। দোগাছিয়া গ্রামেও বেশ কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। কারুকার্য শোভিত রায়চৌধুরী পরিবারের গোপীনাথ জিউ মন্দিরটি কয়েকশো বছরের পুরনো। দোলতলা মন্দির, দশভুজার মন্দিরের কারুকার্যও চেয়ে দেখার মতো। এই ব্লকের ভাতশালা গ্রামে জন্মেছিলেন আধুনিক যাত্রার রূপকার মতিলাল রায়। সেখানে যাত্রা নিয়ে একটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বেদের বঙ্গানুবাদ করে বিখ্যাত দুর্গাদাস লাহিড়ির জন্মও চকবামুনগড়িয়া গ্রামে। অথচ এর তেমন খোঁজ রাখেন না পর্যটকেরা।
দোগাছিয়ার গোপীনাথ মন্দির। নিজস্ব চিত্র।
পঞ্চায়েত সমিতির দাবি, নবদ্বীপে আসা পর্যটকরা যাতে এই এলাকাতেও আসেন সে ব্যাপারে উদ্যোগ করা হচ্ছে। মাঠে নেমেছেম এলাকার মন্ত্রী স্বপন দেবনাথও। তাঁর চেষ্টাতেই প্রায় ২৫ কোটি টাকা খরচ করে প্রাচীন চাঁদের বিল এবং বাঁশদহ বিল সংস্কার করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ঝুলন্ত সেতু, গেস্টা হাউস। ঢেলে সাজছে মুড়িগঙ্গাও। স্বপনবাবু বলেন, ‘‘পরিকাঠামো তৈরির পাশপাশি এলাকায় কী কী সম্পদ রয়েছে তা নিয়ে তত্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে। ‘পূর্বস্থলী ১ ব্লককে চেনো এবং জানো’ নামে একটি বইও প্রকাশ করা হয়েছে। আশা করছি পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে।’’ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিকেরও দাবি, বাছাই করা ১৬টি স্থান উন্নয়নের জন্য দেড় কোটি টাকার প্রকল্প পর্যটন দফতরে পাঠানো হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ হলে এলাকার চেহারা বদলে যাবে।