টুম্পা বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র।
বছর পনেরো আগে স্বামীর সঙ্গেই তাঁত শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। সময়ের সঙ্গে পছন্দ পাল্টে গেল মানুষের, বাজারে চাহিদাও কমে গেল তাঁতের শাড়ির। স্বামী গেলেন নির্মাণ শ্রমিকের কাজে। সংসারের হাল ধরতে তিনি ঠিক করলেন, সাইকেলে ঘুরে ঘুরে পোশাক ফেরি করবেন। কিন্তু পাশে দাঁড়ালেন না স্বামী। হাট থেকে কিনে আনা নতুন শাড়ি নদীর জলে ফেলে দিলেন। সে সব বলতে গিয়ে গলা কেঁপে ওঠে তাঁর। তবে থেমে থাকেননি পূর্বস্থলীর দক্ষিণ শ্রীরামপুর নবপল্লির বাসিন্দা টুম্পা বিশ্বাস। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ব্যবসার টাকা দিয়েই বাড়ি করেছেন, খুলেছেন নিজের দোকান। দারিদ্র্য ও সামাজিক বাধা অতিক্রম করে ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনিই তাঁকে যেন রক্ত-মাংসের দুর্গা করে তোলে।
গ্রামেরই বাসিন্দা শ্যামল বিশ্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয় টুম্পার। তাঁতের কাজ ছেড়ে তখন সংসারে অভাব। টুম্পা কখনও ছোট ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে, কখনও বাজার থেকে ছিট কাপড় কিনে এনে ব্লাউজ় তৈরি করে রোজগারের চেষ্টা শুরু করেন। এক দিন গ্রামে এক মহিলাকে তৈরি পোশাক ফেরি করতে দেখে ঠিক করে ফেলেন, তিনিও এই কাজ করতে চান। সেই শুরু। টুম্পার কথায়, “নিজের জমানো কিছু টাকায় হাট থেকে ১৬টি সুতির শাড়ি কিনে আনি। পরিকল্পনা ছিল, সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করব। কিন্তু স্বামী কিনে আনা সমস্ত শাড়ি ফেলে দেন নদীর জলে। সেই শাড়ি তুলে এনে, শুকিয়ে অল্প লাভে এলাকায় বিক্রি করি।”
তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি। স্বামীর অমতেই চলতে থাকে ব্যবসা। সাইকেলের সামনে-পিছনে ভারী ব্যাগ ঝুলিয়ে গ্রামের মন্দির, বারোয়ারি তলায় হেঁকে হেঁকে বিক্রি করতে থাকেন পোশাক। টুম্পা বলেন, “ব্যবসা বাড়াতে অন্নপূর্ণা স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে ঋণ নিই। সময়ে টাকা শোধ করায় ঋণের অঙ্ক বাড়িয়ে দেয় ব্যাঙ্ক। স্কুটি কিনি। তাতে লাভও বাড়ে। এর পরে কাঠা দুয়েক জমি কিনে বাড়ি করি। প্রয়োজনীয় আসবাব হয়। বাড়ির মধ্যেই বড় জায়গায় রেডিমেড পোশাকের দোকান করি।”
স্বামী এখন মত বদলেছেন। এখন তাঁর ব্যবসাতে সহযোগিতাও করেন বলে দাবি। এখন স্কুটিতে অনায়াসেই ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে চলে যেতে পারেন টুম্পা। তিনি জানান, সপ্তাহে দু’দিন শান্তিপুর, রানাঘাট-সহ বিভিন্ন হাটে ঘুরে শাড়ি, ধুতি, জামা, প্যান্ট, চাদর-সহ বিভিন্ন জিনিস কিনে আনেন। বাকি পাঁচ দিন সমুদ্রগড়, জাহান্নগড়, নবদ্বীপ, ভালুকা-সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে সেগুলি বিক্রি করেন। দুপুরে এক বার বাড়ি আসা, তার পরে আবার বেরিয়ে পড়া। রাত ন’টা থেকে দশটার মধ্যে বাড়ি ফেরা। এই তাঁর নিত্য জীবন।
রাতে একা ফেরেন ভয় করে না?
উত্তরে এক বার রাতে ফেরার অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। পথে কয়েক জন যুবক পিছু নিয়েছিল। স্কুটির সামনেও চলে আসে তারা। তবে রুখে দাঁড়াতেই সরে পড়ে। আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা শোনার পর থেকেই তিনি বিচলিত। তাঁর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া মেয়ের জন্য ভয় হয়। তাঁর দাবি, পথে ঘাটে কাজ করা মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়ানো প্রয়োজন। শ্রীরামপুর সর্বজয়া মহিলা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের কোয়ার্ডিনেটর সবিতা মজুমদার বলেন, “টুম্পার পরিশ্রম করে সফল হওয়া অন্য মেয়েদের কাছে প্রেরনার। ওকে দেখে গোষ্ঠীর মেয়েরাও উজ্জিবিত হয়েছেন।”