স্প্যানিশ গিটার হাতে প্রবীর বক্সী। নিজস্ব চিত্র।
বয়স তখন কুড়ির কোঠায়। কলকাতার বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে মঞ্চে উঠে তখন নিয়মিত স্প্যানিশ গিটারে সঙ্গত দিচ্ছেন ছেলেটি। আচমকা এক দিন কাজী নজরুল ইসলামের পুত্র কাজী অনিরুদ্ধর থেকে ডাক এল কলকাতার রঞ্জিত স্টেডিয়ামে মুম্বইয়ের এক শিল্পীর সঙ্গীতানুষ্ঠানে সঙ্গত দেওয়ার জন্য। অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথেও জানেন না কে সেই শিল্পী।
মঞ্চে গিয়ে দেখলেন তিনি দাঁড়িয়ে, তিনি অর্থাৎ লতা মঙ্গেশকর।— প্রায় ছ’দশক আগের স্মৃতিচারণ করতে করতে চোখ ভিজে এল আসানসোলের গোপালপুরের সেই গিটার-শিল্পী, বছর ৮৪-র প্রবীর বক্সীর। তিনি বলেন, “সেই শুরু। তার পরে লতাজির সঙ্গে আরও বেশ কয়েক বার অনুষ্ঠান করার সৌভাগ্য হয়েছে।” বলতে বলতেই, গিটারে আপন খেয়ালে বাজিয়ে চলেন, “আকাশ প্রদীপ জ্বলে, দূরের তারার পানে চেয়ে...”। ওই গানের সঙ্গীত পরিচালক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। কণ্ঠে, লতা। স্প্যানিশ গিটারটি বাজিয়েছিলেন প্রবীরই। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে থামলেন, বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্র ও আধুনিক বাংলা গানের এই যন্ত্র-শিল্পী।
শিল্পী ফিরে আসেন বাস্তবে। অন্য সপ্তাহের মতো এই রবিবারেও ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিলেন। রেওয়াজ সেরে শিক্ষার্থীদের তালিম দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বেলা গড়াতেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল লতার প্রয়াণ-সংবাদ।
প্রবীর বলেন, “দিনটা আজ যেন বড়ই অন্যরকম।” লতার সঙ্গে স্মৃতির ডালি খুলতে থাকেন তিনি। তিনি জানান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, বীরেশ্বর সরকার-সহ অনেকের সুরেই লতার গানে সঙ্গত করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। সঙ্গে উঠে আসে, লতার সঙ্গে যন্ত্র-শিল্পীদের সম্পর্কের কথাও।
শিল্পী জানান, মঞ্চ হোক বা রেকর্ডিং স্টুডিয়ো, সবসময় লতা সহ-শিল্পীদের খাওয়াদাওয়া হয়েছে কি না, এমন নানা কিছু খুঁটিনাটি খোঁজখবর নিতেন। এমনকি, কখনও কোনও সহ-শিল্পী সঙ্গত দিতে গিয়ে ভুল করলে, নিজের পেশাদারিত্ব দিয়ে তা ঢেকে দিতেন লতা।
প্রবীরের স্মৃতিতে রয়েছে লতাকে দিয়ে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান করানোর প্রসঙ্গও। কলকাতার ১৬ নম্বর অক্রুর দত্ত লেনের গানের স্কুলে তখন ভি বালসারা, কাজী অনিরুদ্ধদের মতো দিক্পালরা তালিম দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। প্রবীরও সেখানে তালিম দিতেন। সালটা ১৯৬৩। কলকাতায় গানের রেকর্ডিং করতে এসেছেন লতা। ভি বালসারা ঠিক করলেন, তাঁদের স্কুলের উদ্যোগে লতার একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। সব শুনে লতা রাজিও হলেন। কিন্তু, অনুষ্ঠানের টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন প্রবীরেরা। এর পরেই ঘটল চমক। প্রবীর বলেন, “মনে আছে গানের শেষে লতাজির হাতে কোনও টাকা নয়, কালীর একটি বড় ফটো তুলে দিয়েছিলাম। তাঁর চোখে-মুখে তখন কী যে আনন্দ।” এর প্রায় চার বছর পরে তৎকালীন মাদ্রাজে একটি তামিল ছবির গানের রেকর্ডিংয়ে গিয়েও লতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রবীরের। খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর, কলকাতার শিল্পীদের।
লতার স্মৃতি তর্পণ করতে-করতেই অনাড়ম্বর ঘরে সন্ধ্যা নামে। প্রবীর ক্রমে চুপ করে যেতে-যেতে বলেন, “লতাজি ছিলেন এক আকাশ প্রদীপের মতো। অনেক দূরের, তবুও যেন ভীষণই কাছের।”